শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নামাজে দাঁড়াতে হবে চিন্তামুক্তভাবে

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

চিন্তামুক্ত দিল নিয়ে নিরাপদ স্থানে নামাজে দাঁড়ানো চাই। এমন অবস্থায় বা এমন স্থানে নামাজে দাঁড়ানো উচিত নয় যেখানে দাঁড়ালে অন্য খেয়াল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক বুজুুর্গানে দীনের ঘটনা আছে যে, তারা নিরাপদ স্থানে নামাজ পড়তেন, যাতে অন্য খেয়াল না আসে। অনেকে দেয়ালের পাশে নামাজে দাঁড়াতেন। যাতে দৃষ্টিতে কোনো কিছু না পড়ে। কেননা নামাজে কোনো জিনিসের প্রতি দৃষ্টি গেলে ওই জিনিসের খেয়াল অন্তরে আসতে থাকবে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) নামাজ পড়ার আগে সম্মুখ থেকে কোরআন শরিফ, তরবারি ইত্যাদি সরিয়ে রাখতেন। কেননা নামাজে তরবারির প্রতি দৃষ্টি পড়লে মন চলে যাবে যুদ্ধের প্রতি, তখন নামাজে মনোযোগ হবে না। তদ্রƒপ কোরআন শরিফের বিভিন্ন আয়াতের প্রতি খেয়াল আসবে। সুতরাং নামাজে দাঁড়ানোর আগে এসব বিষয়ে খেয়াল করা চাই। হাদিসের দ্বারাও এ কথা বোঝা যায়। হাদিসে আছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা ওসমান বিন তালহা (রা.)-কে বললেন, তুমি নামাজে দাঁড়ানোর আগে ডেকচির ঢাকনা বন্ধ করে নিও, যাতে নামাজে দাঁড়ালে এ খেয়াল না হয় যে, ডেকচি থেকে কিছু চুরি হচ্ছে কি না। এর দ্বারা তিনি বোঝালেন যে, বহিরাগত কিছু কারণ আছে, যার দরুন নামাজে মন বসে না। সেগুলো দূর করে নামাজে দাঁড়ানো উচিত।

আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে উল্লেখ আছে যে, একদা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নকশাবিশিষ্ট জামা পরিধান করে নামাজে দাঁড়ালে নামাজের মাঝে নকশার দিকে দৃষ্টি পড়ল। নামাজান্তে তিনি বললেন, এ জামা আবু জাহামের কাছে নিয়ে যাও এবং তার থেকে নকশাবিহীন জামা নিয়ে এসো। কেননা এ জামাটা আমাকে নামাজ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছে। হাদিসটি ইমাম বুখারি ও মুসলিম (রহ.) বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসের মাঝে সাধারণত প্রশ্ন হয় যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে কীভাবে জামার দিকে লক্ষ্য করলেন, তাহলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাজও কি অসম্পূর্ণ হয়েছে? উত্তরস্বরূপ অনেক কিছু বলা যায়, তবে আসল কথা হলো, উম্মতের মাঝে দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি এমনটা করেছেন। হজরত আবু জাহাম নবীকে ওই জামাটা হাদিয়াস্বরূপ দিয়েছিলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পরিবর্তন করে নকশাবিহীন জামা আনলেন। ওই হাদিস থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, এমন জামা পরিধান করে নামাজ না পড়া উচিত যার প্রতি দৃষ্টি পড়তে পারে। জামা উন্নতমানের হলে দিলে অনেক সময় অহংকার জন্ম হয়। যে যত বেশি দামি জামা পরিধান করে, তার মাঝে তত বেশি অহংকার দেখা যায়। তাই বুজুর্গগণ বেশি দামি জামা পরিধান করতেন না। তারা একেবারে কম দামের জামা পরতেন। কেউ কেউ জামা তালি দিয়ে পরতেন। এর দ্বারা অহংকারের লেশমাত্র থাকত না। আমাদের সমাজ তো এমন যে, জামা উন্নত হলে জনসমাজে সম্মান পাওয়া যায়। একজন আলেম যত বড় আলেম হোক তার গায়ে যদি নিম্নমানের জামা হয় মানুষ তাকে চেনে না, সম্মান করে না। জামা উন্নত হলে চোখ বড় করে তাকায় আর মনে মনে তাকে বড় আলেম জ্ঞান করে। এ ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা আছে।

হজরত শেখ সাদী (রহ.) একদা এক এলাকায় ভ্রমণ করেন তখন তাঁর পরিধানের বস্ত্র ছিল নিম্নমানের, যার দরুন এত বড় আলেম ও বুজুর্গ হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাঁকে মূল্যায়ন করল না। একবেলা খাবার পর্যন্ত দিল না। যাই হোক শেখ সাদী (রহ.) এক বছর পর অত্যন্ত দামি জামা পরিধান করে ওই এলাকায় পুনরায় গমন করলেন। এবার লোকজন মনে করল, অনেক বড় আলেমের আগমন ঘটেছে। তাই সবাই তাকে সম্মান দেখাল এবং দাওয়াত খাওয়াল। তিনি একজনের বাড়িতে মেহমান হলেন। সামনে বিভিন্ন সুস্বাদু ও রুচিসম্মত খাদ্য পরিবেশন করা হলো। তিনি খাদ্য ভক্ষণ না করে লোকজনকে লক্ষ্য করে বললেন, এ শাহিখানাগুলো আমার জামায় তুলে দাও। এবার লোকজন অবাক চিত্তে তাকিয়ে বলল, কী বলেন হুজুর! জামায় কি খানা দেওয়া যায়? শেখ সাদী বললেন, আমি ঠিকই বলছি, তোমরা বুঝতে ভুল করছ। তোমরা তো এ খাদ্য আমার জন্য আননি। তখন তিনি ঘটনা খুলে বললেন যে, এক বছর আগে যে লোকটা তোমাদের কাছে আগমন করেছিল, আজ সেই লোকটিই এসেছে। এক বছর আগে আমি কোনো সম্মান ও খানা পাইনি। কারণ আমার পরনের বস্ত্র ছিল নিম্নমানের। আজ আমার সামনে এত খাদ্য এবং এত সম্মান প্রদর্শনের কারণ হলো- এবার ভালো ও দামি জামা পরে এসেছি। তোমাদের খানা ও সম্মান জামার জন্য, আমার জন্য কিছু নয়। তাই খানা দিতে হলে জামাকে দিতে হবে। তখন লোকজন সীমাহীন লজ্জা পেল।

অহংকারের উৎপাদন বন্ধ করতেই সব হাজিদের একই লেবাস, একই পোশাক। জামা বেশি দামি হলে অহংকার আসে, নামাজে আসে অমনোযোগিতা, পক্ষান্তরে জামা কম দামি হলে নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহান ইবাদতে ইখলাস আসে আর অহংকারের মতো জঘন্য গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। হজের মধ্যে সবার গায়ে এক ধরনের জামা। যাতে অহংকার না আসে। হজ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাঝে অহংকার থেকে বাঁচার যত পন্থা আছে, আল্লাহপাক সবগুলো অবলম্বনের নির্দেশ দান করেছেন। তাই দেখা যায় সবার জামা এক ধরনের। সবার গায়ে  সেলাইবিহীন জামা। সুতরাং কেউ অহংকার করে না। অনেক সময় মানুষ ভাষার তারতম্যের দরুন অহংকার করে। কারও ভাষায় সাহিত্য ফুটে ওঠে, আবার কারও কথায় মাধুর্যতা বেশি পাওয়া যায়, আবার কখনো ভাষা আরবি বা ইংরেজি হওয়ায় অন্যের ওপর অহংকার করে। কিন্তু হজের মাঝে মানুষ সবগুলো থেকে মুক্ত থাকে। কারণ, সবার মুখে এক বাক্য, এক ভাষা। সব হাজি ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...’ ধ্বনিতে ময়দান মুখরিত করে তোলে। ধনী, গরিব, আরব-অনারব নির্বিশেষে সবার মুখে একই ধ্বনি। এর দ্বারাও অহংকার থেকে মুক্ত থাকা যায়। কোনো এলাকায় যদি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর আগমন হয়, তাহলে ওই এলাকার রাস্তাঘাট পরিষ্কারকরত নিরাপত্তার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর দ্বারা মেহমানের মধ্যে অহংকারের পরিমাণ বৃদ্ধিই পেতে থাকে। কিন্তু হজের মাঝে তা নেই, রাজা বাদশাহ ও মন্ত্রী মিনিস্টার সবাই গরিব শ্রেণির লোকদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে হজের বিধিবিধান পালন করতে থাকে। কারও জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।  যাই হোক, এ দীর্ঘ আলোচনার দ্বারা বোঝা গেল, নামাজে বিলাসিতা করা যাবে না। বিলাসিতা করে নামাজে দাঁড়ালে অমনোযোগিতা চলে আসবে; এর দ্বারা নামাজে আসবে ওয়াসওয়াসা। ওয়াসওয়াসা পরিহার করার লক্ষ্যে বিলাসিতা বর্জন ও খোদাভীতি অর্জন আবশ্যক। আল্লাহপাক আমাদের ওয়াসওয়াসহীন সহিশুদ্ধ করে নামাজ পড়ার তৌফিক দান করুন।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর