টাকা সব সময় রঙিন। তবে যে টাকার আয় এবং আয়ের উৎস ঘোষণা না দিয়ে রাষ্ট্রের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়া হয় বা যায়, যে টাকা অবৈধভাবে অর্জিত, সে টাকাই কালো টাকা। মূলত এবং মুখ্যত এ কালো টাকাই যে কোনো অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য, প্রতারণা, বঞ্চনার, অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যত্যয়ের প্রমাণক। অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি ও ন্যায়নীতি নির্ভরতাবিহীন তারই সূচক এবং অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিচ্যুতির মাধ্যমে ক্ষতিসাধনের প্রভাবক ভূমিকা পালন করে এ কালো টাকা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আবহমান কাল থেকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নানান আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে।
কালো টাকা সাদা করার পদ্ধতি প্রক্রিয়া নিয়ে নানান মতভেদ যা-ই থাকুক না কেন, এর যথা বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। সরকার পরিচালিত রাজনৈতিক অর্থনীতির হওয়া উচিত নয়। অবশ্যই কালো টাকা সমাজের বা সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনৈতিকতা ও অবস্থাপনার সৃষ্টি, স্বচ্ছতা জবাবদিহি ও ন্যায় ন্যায্যতা নীতি নির্ভরতায় বিপুল ব্যর্থতার প্রতিফল। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক নজির থেকে দেখা যায়, তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার পর হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পেরেছে। এসব দেশ প্রথম পর্বে কালো টাকাকে প্রযত্ন দিতে সাদা করাকে গুরুত্ব দিত, পরবর্তীকালে শক্ত হাতে কালো টাকা সৃষ্টির উৎস বন্ধ করার রাষ্ট্রীয় প্রতিবিধান জোরদার করার ফলে সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতি সঞ্চার হয়েছে। আরও খোলাসা করে বলা যায়, যেমন সুহার্তোর ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের শাসনকে ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নতত্ত্বে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আখ্যায়িত হতো, গত দুই দশকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হওয়ায় সেখানে এখন অর্থবহ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে।
আমাদের এ উপমহাদেশে ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত কর আহরণ পদ্ধতি সংস্কার কর্মসূচির আওতায় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত অর্থনীতি থেকে কালো টাকা সাফ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। দুর্নীতি দমনের ঘোষণা দিয়ে আসা সামরিক সরকার তা লেজেগোবরে মিশিয়ে ফেলে। সেখানে উদ্দেশ্য বিধেয়র মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১৯৯৭ সালে ভলান্টারি ডিসক্লোজার অব ইনকাম স্কিম (অভিইউএফ আইএ) অ্যান্ড ইমপোজিশন অব ট্যাক্স অ্যাক্ট জারি করে। ভিডিআইএস প্রবর্তনের পর ‘কম্পট্রোলার অব ইন্ডিয়া’ তার এক প্রতিবেদনে এ স্কিমের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি এ ব্যবস্থাকে as abusive and a fraud on the genuine taxpayers of the country বলে অভিমত দেন। ভারতীয় সি অ্যান্ড এজির অভিযোগ ও ঘোর আপত্তি ছিল এ জন্য যে, এটি বরং কালো অর্থনীতিকে সাদা করার নামে অন্যায় অনিয়মকে সেফ এক্সিট দেওয়ার বাহানা।
বাংলাদেশে বছর বছর কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটি হালকা করার অবস্থান নেওয়াকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচনা হচ্ছে। সংবিধানের ২০(২) ধারায় বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না’। সংবিধানের এ বিধানমতে ‘অনুপার্জিত আয়’ যদি কালো টাকা হয় তাহলে কালো টাকার সংজ্ঞা ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ এবং এ সংজ্ঞা দুর্নীতির সঙ্গে কালো টাকার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক- সেটাকে অনেকটাই গৌণ বা লঘু করে দিতে পারে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, অনেক সময় বৈধভাবে অর্জিত অর্থের ওপর যেমন জমিজমা, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, দোকান ইত্যাদি রিয়েল এস্টেট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রকৃত দাম না দেখিয়ে কম দাম দেখালে রেজিস্ট্রেশন খরচ, স্ট্যাম্প খরচ, সম্পদ কর ও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে কালো টাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বলাই সংগত এবং তা প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই, বছর বছর সময় দিয়ে নয়, নয় বিদ্যমান কর হার হ্রাস করে এবং জরিমানা না দিয়ে এবং কোনো অবস্থাতেই অবৈধ অর্জন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার মাধ্যমে দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও উৎসাহিত করে নয়। আয়কর আইনে প্রযোজ্য কর, জরিমানা পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সর্বজনীন সুযোগ রাখাই আছে। সেটিই সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য থাকা উচিত। প্রসঙ্গত যে, ২০০৭-০৮ অর্থবর্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০০৮) প্রযোজ্য করসহ বছর প্রতি ১০ শতাংশ হারে (সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ) জরিমানা দিয়ে এ জাতীয় অপ্রদর্শিত আয় ‘প্রদর্শন’ বা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সময় শেষ হওয়ার পর যাদের কাছে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা পাওয়া যেত, তাদের বিরুদ্ধে আয়কর আইনেই জেল জরিমানার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। সে সময় এ স্কিম ইতিবাচক ফলাফল এনে দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সময়সীমা অবারিত করে, বছর বছরব্যাপী করে, জরিমানা না দিয়ে, হ্রাসকৃত হারে কর দিয়ে এবং অপ্রদর্শিত আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না- এ ধরনের ইমিউনিটি দিয়েও কালো টাকা সাদা করায় সাড়া পাওয়া যায়নি। কালো টাকার রাজনৈতিক অর্থনীতির এ চেহারা ও চরিত্র সবার জন্যই, সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য, মূল্যস্ফীতির জন্য বেশ উদ্বেগজনক এবং তার উদ্বাহু বিকাশ ও ব্যবহার বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের বহির্প্রকাশ।
আশির দশকের তুলনায় নব্বই দশক থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে বাড়তে তখনকার সাড়ে ৪-৫ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছলেও এ প্রবৃদ্ধির সুফল প্রধানত কয়েক হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। একজন বিচারপতি বিদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এদেশে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন, তার দখলে কয়েক শ একর জমি জমে এবং দেশ ছেড়ে পালানোর সময় ৬০-৭০ লাখ টাকা ছিনতাইকারীদের হাতবদল হয়। সে জন্যই মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল এ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক ব্যক্তিদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ণীত হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগের ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা (৭৫ বিলিয়ন ডলার) বিদেশে পাচার হয়েছে বলে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি’র গবেষণায় উদ্ঘাটিত হয়েছে। সারা বিশ্বে তো বটেই বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষের মাথাপিছু আয় ও সম্পদ কমে গেলেও নির্বাচনের ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত সম্পদের পাহাড়সম প্রবৃদ্ধি বৈষম্যের বিড়ম্বনার সামান্য অংশ প্রকাশ পায়। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ এম এল এম কেলেঙ্কারি, রাতারাতি মালিকানা দখলকারী ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির সাগর চুরির পর, বেশিদিন আগের কথা নয় ক্যাসিনোকাণ্ড, প্রখ্যাত প্রতারক, মাথার মাথাদের, স্বনামধন্য গাড়িচালক, সরকারপ্রধানের পিয়ন, ছাগলকাণ্ডের নায়ক-নায়িকা, চোরাচালানির মর্মান্তিক মৃত্যুর ছিটেফোঁটা কেচ্ছা কাহিনি থেকেও তো অনুমান করা চলে কী ধরনের ক্ষরণের শিকার হতে চলেছে এ অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আইসিইউতে। তারপরও স্বেচ্ছা সহনশীল সলিলা (রেজিলিয়েন্ট) শক্তির জোরে, ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার ইমিউন পাওয়ার এখনো বলশালী বলেই অর্থনীতি স্ট্রোক করছে না। ২০২৪-এর ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এটাকেই আত্মতুষ্টির হেতু ধরে নিয়ে অর্থনীতির মৌল সহায়ক নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার স্মার্ট চেষ্টা ছিল অদম্য অগ্রগতির ভাষা। প্রতিকার প্রতিবিধান ছাড়া কালো টাকা অর্থনীতির জন্য অর্থনীতির ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না।
সৎ ও নিয়মিত করদাতা ১৫-২৫ শতাংশ কর দেবেন আর কালো টাকার মালিক ১০/১৫ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করতে পারবে, এ নীতির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত যে বছরের পর বছর ৭/৮ শতাংশের নিচে রয়ে যাচ্ছে, তার অনেক কারণের মধ্যে এহেন অনৈতিক নীতির পরিপোষণ এবং কালো টাকার দাগি আসামিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া একটি।
বছর বছর কালো টাকায় কেনা স্থাবর সম্পত্তি নিয়মিত করার সুযোগ দিয়ে এ সম্পত্তি ব্যবহারজাত আয়ের ওপর কর আহরণের বিষয়েও ছলচাতুরির প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এ নজিরের ফলে এ ধরনের খাতে কর প্রদানে বিলম্ব বা বিরত থাকার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। যারা রাষ্ট্রের সব নিয়মকানুন মানার বাঁধার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে স্থাবর সম্পত্তি, অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল, হাইটেক পার্ক, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের সেই পরিশ্রম ও কর প্রদান অপমান অবমাননার শিকার হয়েছে বিনা ব্যাখ্যায়, জরিমানা ও কর প্রণোদনা দিয়ে জামাই আদরে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার ফলে। অর্থনীতিতে, বিশেষ করে কর রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে নৈতিক দাবি দুর্বল হবে এবং তার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
অর্থনীতিতে কালো টাকা ফিরিয়ে আনার প্রথম ও প্রধান উপাদেয় উদ্দেশ্য জরিমানা ও নিয়মিত কর আদায়, তারপর পুষ্টিকর খাতে সেই অর্থ বিনিয়োগ। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ নীতিভ্রষ্টতার দোষে নানান আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরীক্ষা পর্যালোচনায় কালো টাকা পুষ্টিসাধনের নিমিত্তে অর্থনীতিতে ফিরে আসার পরিবর্তে অর্থনীতি বরং কালো টাকামুখী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েছিল। কালো টাকা গণতন্ত্রসহ সব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সংক্রমণ এবং দখল করার পথে ছিল ধাবমান। রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’-এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যে কোনো অর্থবিত্তকে কালো টাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেটাই সাংবিধানিকভাবে বেশি যৌক্তিক। এর আলোকে দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ বেড়াজাল থেকে আইনের আওতায় ‘মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ-আইনজীবী-বিচারক, ঘুষখোর সুশীলসেবক (আমলা) এবং মুনাফাবাজ/ কালোবাজারি/চোরাকারবারি/ব্যাংক ঋণ লুটেরা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের’ অপরাধের শাস্তি বিধান করা হলেই সমাজে ও অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক বার্তা যাবে। তা না হলে দেশ সমাজ ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারবিজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ-এর কনসেপ্ট ‘নৈতিক বিপদ’-এর উপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে।
আশার বিষয়, কালো টাকা সাদা করার বিধি ও রীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। উপদেষ্টা পরিষদ মনে করেছে, বিগত সরকারগুলো জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দিয়েছিল, তা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব। এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান