মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আজ মঙ্গলবার ভোট নেওয়া হচ্ছে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার জন্য তাঁদের প্রচারণাকালে যেসব কথাবার্তা বলেছেন তাতে ভোটার ও অভোটার মানুষেরা অনেকে চমকিত, বিস্মিত, উত্তেজিত এমনকি আমোদিতও হয়েছেন। দিন চারেক আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মধ্যাহ্নভোজ-উত্তর আড্ডায় প্রশ্ন ওঠে, সুদূরেরও সুদূর আমেরিকার নির্বাচনে ‘কে জিতবে, কে হারবে’ নিয়ে নিরীহ অপুষ্ট রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিকরা উতলা কেন? কেনই বা বাংলাদেশি পত্রপত্রিকা ওই দেশের ভোটপ্রার্থীদের বোলচালের বর্ণনায় বিস্তর জায়গা খরচ করে? কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো, তাতে আমাদের কী আসে যায়?
প্রশ্ন করেছিলেন একজন, উত্তর নামধেয় ব্যাখ্যায় মগ্ন হলেন কয়েকজন। ক্লাবের এক সভ্যের মতে, ব্রিটিশ যুবরাজ চার্লসের সঙ্গে ডায়ানার বিবাহ উৎসবের বর্ণাঢ্য ব্যাপারস্যাপার টেলিভিশনের সামনে ঘণ্টা দুয়েক ধরে বসে বসে দুচোখ দিয়ে যে কারণে বাংলাদেশিরা গিলেছিল, সেই একই কারণে কমলা না ট্রাম্প- কমলা কমলা; ট্রাম্প না কমলা- ট্রাম্প ট্রাম্প করা হয়। তালেবর তো হলাম না, তালেবরদের শানশওকত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে একটু তৃপ্তিলাভের চেষ্টা আরকি। ‘কে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে বেশি উপকার, এমন গবেষণায় সরলসিধা দেশগুলোর সময় বরবাদ করা ঠিক নয়’ মন্তব্য করলেন আরেক সভ্য। তিনি জানান, কিউবায় কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হওয়ার পরের সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চলছিল। প্রার্থী ছিলেন রিপাবলিকান রিচার্ড এম নিক্সন এবং ডেমোক্র্যাট জন এফ কেনেডি। ইউরোপীয় এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এঁদের মধ্যে কে নির্বাচিত হলে কিউবা স্বস্তিবোধ করবে। উত্তরে কিউবার বিপ্লবের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রো বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পদটি থ্রি-পিস স্যুটের মতো। নির্বাচনে ঠিক করা হয় কে এটা পরবে। লোক বদল হয়, স্যুট আগেরটাই থাকে।’
ফিদেল বোঝাতে চেয়েছেন যে, নিক্সন বা কেনেডি কেউ-ই তাঁর দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হওয়ার নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা তট থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবায় ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্টরা শাসনক্ষমতায় বসে গেল, এ যে মহাশক্তিমান আমেরিকার জন্য গ্লানিকর! গণতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্রের বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র সেই গ্লানিমোচন চেষ্টার পর্যায়ে ফিদেল কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। এ ব্যর্থতা আর অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সংঘশক্তি বৃদ্ধি থেকে উৎসারিত বেদনায় ভোগা মার্কিন রাজনীতিকরা ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘আমেরিকা ডিপ্রাইভড ফ্রম ইটস গ্রেটনেস ডিউ টু ডিসগ্রেস অব ইলেক্ট লিডারশিপ।’
১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ছিল শ্বেতাঙ্গ। দিনে দিনে এই সংখ্যা কমেছে। এখন শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা ৭০ শতাংশ। ২০৪৪ সাল পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর যে অবস্থা হবে তাতে তারা ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ হয়ে যাবে। এই ভয়ে তাড়িত হয়েই ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানকালে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জজবা তোলেন ‘মাগা! মাগা!’ মানে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (আমেরিকাকে ফের মহান করে তোল)। মার্কিন সমাজের সর্বস্তরে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য কামনায় এই স্লোগান এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও উচ্চারণ করা হয়েছে। কারণ ‘মাগা’ এখন রিপাবলিকান পার্টির মূল মানসের অংশে পরিণত।
অবস্থাদৃষ্টে এশীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকা বাইরে থেকে উন্নত, ভিতরে ভিতরে ফোকলা হয়ে আছে। তার মহত্ত্ব আছে প্রচারণায়। বাস্তব বলছে, সে উন্নতি বলতে গেলে সাদা মানুষের উন্নতি। সমাজপ্রগতি বলতে সে বোঝে পুরুষশ্রেণির প্রগতি। তার মানসপ্রকৃতিতে রয়েছে বিকার; যে জন্য ২০১৬ সালে ‘হিলারি ক্লিনটনের মতো বিদ্বান, সুস্থির ও প্রাজ্ঞ নারীকে ত্যাগ করে ট্রাম্পকে বিজয়মালা পরিয়ে গোটা দুনিয়াকে থতমত করে দিয়েছিল। এই পটভূমিতে আরেক নারী কমলা হ্যারিস ২০২৪ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ট্রাম্পের সঙ্গে। ইনি সেই ট্রাম্প যিনি দুদুবার মার্কিন সংসদে (কংগ্রেস) অভিশংসিত হয়েছেন, ৩৪ দফা ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। যাঁকে জেনারেল জন কেলি (একদা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ) ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন। রিপাবলিকান পার্টির সাবেক নেত্রী লিজ চেনি (সাবেক রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে) বলেন, ট্রাম্প লোকটা প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। লিজ ও তাঁর বাবা বলেছেন, ‘আমরা কমলাকেই ভোট দেব।’
মনে হচ্ছে হাওয়া কমলার পক্ষে? না। বিখ্যাত জরিপ বিশেষজ্ঞ নেইট সিলভার দোদুল্যমান (কাকে ভোট দেবে সিদ্ধান্তহীন) সাতটি রাজ্যে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গত সপ্তাহে বলেছেন, ভাবসাবে মনে হয় কমলা হ্যারিস হারছেন। একজন নারীকে (কমলা হ্যারিস) ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে আমেরিকার লেগে গেছে ২৪৪ বছর। চার বছরের মধ্যেই তার মানসজগৎ একজন নারী প্রেসিডেন্টবরণে হয়তো প্রস্তুত নয়। তাহলে নারী প্রেসিডেন্ট পেতে কত শতক অপেক্ষমাণ থাকবে আমেরিকা? নারীদের সামনে এই যে বাধা একে ‘কাচের দেয়াল’ বলেছেন হিলারি। এটা তিনি ভাঙতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেননি। কমলার সামনেও সেই চ্যালেঞ্জ। কমলা হেরে গেলে দায়ী হবে পুরুষরা বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা- এরা নারী প্রেসিডেন্ট দেখতে অনাগ্রহী। তাই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের উদ্দেশে বারাক ওবামা বলেছেন, ‘তোমরা কমলাকে ভোট দিতে ইতস্তত করছ। ডেমোক্র্যাট পার্টি এটা করেনি, সেটা করেনি বলছ। আদতে তোমরা নারী বলেই কমলাকে অবজ্ঞা করছ। কমলা তোমাদের মতো অবস্থা থেকেই সংগ্রাম করতে করতে এখানে এসেছে। তোমাদের উচিত তাঁকেই ভোট দেওয়া।’
পুরুষ ভোটাররা মনে করেন, ট্রাম্প হলেন বলবান ও পৌরুষধারী মানুষ। আততায়ীর গুলি খেয়েও তিনি কাবু হন না। গুলিতে রক্তাক্ত হয়েও হাত উঁচিয়ে এই বাপ কা বেটা আওয়াজ দেন, ‘লড়াই’! ‘লড়াই!’ শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ উভয় পুরুষ সমাজের ট্রাম্পের এই লড়াকু জেদ পছন্দ। ট্রাম্প বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হয়েই ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ বহিরাগতকে বের করে দেব, প্রয়োজনে আর্মি ব্যবহার করব।’ মজার ব্যাপার! এই আস্ফালনে উদ্দীপ্ত হয়েছেন ‘বহিরাগত নিপাত যাক’ মানসিকতাসম্পন্ন একদার বহিরাগতরাও।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উদ্বেগের বিষয়- বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা ও জো বাইডেন যে হারে আফ্রিকান-আমেরিকান ভোট পেয়েছেন, কমলার সে হারে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় না। ওই তিনজন পেয়েছিলেন প্রায় ৯০ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষের ভোট। সেই সমর্থন কমলার বেলায় ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে আশার কথা, ৫০ বা ততোধিক বয়সি নারীরা কমলার প্রধান ভোটব্যাংক। সংখ্যার দিক থেকে তাঁরাই প্রধান ভোটদাতা। এঁদের সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ এবং তাঁদের ৯৭ শতাংশ নিয়মিত ভোট দিয়ে থাকেন। আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষরা নারীর প্রতি কম শ্রদ্ধাশীল, কম মনোযোগী। আমেরিকান পুরুষরা (সাদা ও কালো) চান, রাজনীতিকরা তাঁদের প্রয়োজন মেটানোর দিকে মনোযোগী হোন। কারণ নারীবাদী আন্দোলনের ফলে তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাই তাঁরা কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বপ্রত্যাশী হয়ে রিপাবলিকান পার্টির দিকে ঝুঁকছেন। এক জরিপে দেখা যায়, ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সি পুরুষরা মনে করেন, ট্রাম্প তাঁদের স্বার্থের সেরা রক্ষক।
শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বুলি কপচিয়ে ২০১৬ সালে ট্রাম্প জিতে গিয়েছিলেন ইলেকটোরাল ভোটে। পপুলার ভোট বেশি পেয়েছিলেন হিলারি। ইলেকটোরাল ভোটের পদ্ধতিতে যে রাজ্যে যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন তিনি ওই রাজ্যে সব ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য হবেন। অর্থাৎ ৫০ অঙ্গরাজ্যের মধ্যে যিনি বেশির ভাগ ভোট পেলেন তিনিই প্রেসিডেন্ট। আমরা তো ধাঁধায় ভোগী। এভাবেই জেতা যায় তাহলে পপুলার ভোট নেওয়া হয় কেন?
২ নভেম্বরের খবরে জানা যায়, মোট ভোটারের ৫০ শতাংশ মনস্থির করে ফেলেছেন কাকে ভোট দেবেন। ৫০ শতাংশ মার্কিনিকে নিয়ে বার্নার্ড শ কী ভাবতেন তা ইতিহাস হয়ে আছে। বার্নার্ড শ যুক্তরাষ্ট্র সফরের একপর্যায়ে হার্ভার্ডে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় বলেন, ‘জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে আলোকিত করার বিস্তর সুযোগ সত্ত্বেও আমেরিকানদের অর্ধেকাংশ বোকা রয়ে গেল। (হাফ অব আমেরিকান আর ফুলস)’। শ্রোতারা হইচই করতে থাকে। বার্নার্ড শ বলেন, ‘লেট মি ফিনিশ। লেট মি ফিনিশ।’
শ্রোতারা নীরব হলে তিনি বলেন, ‘হাফ অব আমেরিকান আর ভেরিমাচ ইন্টেলিজেন্ট (আমেরিকানদের অধিকাংশ খুবই বুদ্ধিমান)।’ এবার শ্রোতারা তুমুল করতালি দিতে থাকেন। বার্নার্ড শ বললেন, ‘বন্ধুগণ! এই করতালি প্রমাণ করছে, প্রথম যে মন্তব্যটি করেছিলাম তা শতভাগ যথার্থ।’
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন