কাজ চালানোর স্বার্থে কিছু বিদেশি শব্দ বা বাক্য শিখে রাখাটা ভালো। সব সময় সেটা ভালো ফল দেবে, এমন আশা পোষণ ঠিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ চালানোর ওই বিদ্যাটা মাথায় রক্ত উঠিয়ে দেয়। আমার প্রয়াত ননী মামার রক্ত এতটাই উঠেছিল যে তিনি ‘ইতালীয়মাত্রই বেজন্মা’ ধরনের চরম ভয়ংকর-অসভ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। মায়ের এই চাচাতো ভাইটিকে রাব্বুল আলামিন চমৎকার একটা গুণ দিয়েছিলেন। যখনই টের পেতেন যে তাঁর কোনো আচরণ ভুল বা অন্যায়, তখনই ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পাঠ করে নিজেকে নিজে চপেটাঘাত করতেন।
ইতালির সব নাগরিকের জন্মের বৈধতাবিষয়ক যে অশিষ্ট ধারণা তিনি উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করেছিলেন তার নেপথ্যে ছিল তাঁর সুগভীর ভালোবাসা। পাকিস্তানকে তিনি জানের জান প্রাণের প্রাণ নয়নের তারা গণ্য করতেন। ইতালীয় এক পর্যটক, নাম ব্রডোলো, সেই প্রিয়তম পাকিস্তানকে তামাম দুনিয়ার সামনে অবজ্ঞাপূর্বক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। লোকটা কাজ চালানোর মতো বাংলা শিখে নিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাংশ (যাকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান) সফর করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি শহর পর্যটনের সময় সে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আশপাশে সাঁটানো ফলকের লেখাগুলো পড়েছে। সেই অভিজ্ঞতায় পুষ্ট পর্যটক ব্রডোলো স্বদেশে ফিরে ভ্রমণ কাহিনি রচনা করে।
নিবন্ধের এক জায়গায় আছে-পূর্ব পাকিস্তানিরা অতিথিপরায়ণ। ওরা বিদেশিদের অসুবিধামুক্ত রাখতে সদা তৎপর। মজাদার সব খাবার খাওয়ায়। ঘুমানোর জন্য যত্ন করে বিছানায় মশারি টানিয়ে দেয়। রাত্রিযাপন করতে দেয় বিনামূল্যে। রাজশাহী নামের শহরে আমি একদিন টানা চার ঘণ্টা ছুটোছুটি করেছি অটোরিকশায়। চালক অর্ধেক ভাড়া নিয়েছে। আমি পুরোটা দিতে জোরাজুরি করলে সে বলে, ‘তুমি আমাদের মেহমান। পুরো ভাড়া নিলে আল্লাহ নারাজ হবেন।’
ব্রডোলো জানায়, এ রকম সৌজন্যবোধ বাঙালি-অধ্যুষিত সব শহরে দেখেছে। চা খেলে দোকানি দাম নেয়নি। হোটেলে ভরপেট বিরিয়ানি খেয়েছে, দাম রেখেছে অর্ধেক। এরপর দই খাইয়েছে ফ্রি। পাকিস্তানের মানুষ, পাহাড়-নদী-ফসলের খেত মুগ্ধকর। দেখলে নয়ন জুড়ায়। পীড়াদায়ক শুধু একটি বিষয়। ব্রডোলো লিখেছে, ‘পাকিস্তানিরা উন্মুক্ত স্থানে প্রসব করতে অভ্যস্ত। জঘন্য কাজটি বন্ধ করতে পাকিস্তান সরকার যে সচেষ্ট তা পরিষ্কার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফলকে লেখা নোটিসে হুঁশিয়ারি দেখেছি তাতে বলা আছে, এখানে প্রসব করবে না। করলে শাস্তিভোগ করতে হবে।’
অল্প বিদ্যা ভয়ংকর। ব্রডোলো বাংলা ভাষার যা আয়ত্ত করেছে তা তো অত্যল্প বিদ্যা। তাই ফলকে লেখা সাবধান বাণীর উল্টো অর্থ করেছে। অর্থকরণটা খুবই আপত্তিকর। তাই নাগালে পেলে ননী মামা যে ওর হাত কেটে পায়ে এবং পা কেটে হাতে ফিট করে দিতেন তাতে কোনো সন্দেহ করা অনুচিত। সাবধান বাণীতে বলা ছিল, ‘এখানে কেউ প্রস্রাব করিবেন না। করিলে আইনত দণ্ড ভোগ করিতে হইবে।’ পঠনকালে ব্রডোলোর দৃষ্টিভ্রম ঘটে। ফলত সে ‘প্রস্রাব’কে ‘প্রসব’ মনে করেছে।
বাবা বললেন, ‘কাজটা ঠিক করলেন না ননী। একজন ইতালীয় দোষ করেছে বলে তুমি সব ইতালীয়র জন্ম কলঙ্কিত-এ রকম ফতোয়া দিয়ে বসেছ। তোমার মতো সাচ্চা আশিক-ই-পাকিস্তান এমন বেইনসাফি করবে কল্পনা করতেও কষ্ট হয়।’ ননী মামা বলেন, ‘স্যরি দুলাভাই।’ এরপর নিজের দুই গালে হালকা চপেটাঘাত করে আওয়াজ দেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’।
অনুতাপ প্রকাশের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি তাঁর ভগ্নিপতির সঙ্গে ইউরোপীয় সভ্যতার ভণ্ডামির ওপর এক বিতর্কে অবতীর্ণ হলেন। ননী মামার মতে, ভণ্ড গবেষক ব্রডোলো পাকিস্তানি নারীসমাজ সম্বন্ধে যে জঘন্য মানসিকতা দেখিয়েছে ওটাই প্রকৃত ইউরোপীয় মানস। শিক্ষা, জ্ঞান, সংস্কৃতি, তপস্যা, ভদ্রতার ক্ষেত্রে ইউরোপকে সাত আসমান সমান উঁচু মনে করে পাকিস্তান। কিন্তু ওরা... ওরা....।
উত্তেজনায় তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ। বাবা জানতে চান, ওরা কী? ননী মামা বলেন, ‘ওরা তোড়ায় ভরা ঘোড়ার ডিম।’
ঘোড়ার ডিম তো জানি, কাল্পনিক বস্তু। ওটা তোড়ায় ভরার উপায়? ননী মামার কাছে একদিন জানতে গেলে তিনি বলেন, ঘোড়ার ডিম ব্যাপারটাও বুঝিস না। এই বিদ্যা নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছিস আর রাস্তায় রাস্তায় মিছিলে মিছিলে ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ স্লোগান দিচ্ছিস! লজ্জা করে না? গাধার গাধা কোথাকার!
ঘোড়ার ডিম ইজ ইকুয়াল টু ভুয়া। ঘোড়ার ডিম মানে অস্তিত্বরহিত। ঘোড়ার ডিম মিন্স্ বোগাস ম্যাটার। ঘোড়ার ডিম তাহাই, যা হাকে সভ্যজনরা চরম অপদার্থ বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন।-এসব তথ্য না জানাটা লজ্জাজনক কাজ কেন, ননী মামা তা খোলাসা করেননি। তবে সেদিন তিনি তাৎপর্যময় একটা খবর দিয়েছিলেন, ‘জগৎ সংসারের এখানে-ওখানে ঘোড়ার ডিম পাড়া চলছেই। দেখার জন্য নজর ধারালো করা চাই।’
ননী মামা দুনিয়া ত্যাগ করেছেন ত্রিশ বছর হলো। ধারণা করি, শ্রবণ ধারালো করার ওপরও জোর দেওয়া যে আবশ্যক, সেটা বলতে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। মনোজ মনোহর শ্রেষ্ঠর শ্রবণ ধারালো না থাকায় তিনি ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন। ঘটনাটি ঘটে তিনি ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে। কৃষিতে উচ্চতর ডিগ্রি হাসিলের পর মনোজ শ্রেষ্ঠ তাঁর স্বদেশ নেপালে ফিরে গেছেন এরশাদীয় জমানায়। নেপালি এক পত্রিকায় তাঁর ময়মনসিংহ জীবনের স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন-ছাত্রবাসে আমার কক্ষসঙ্গী মোতালিব শরীফকে বললাম, রেলস্টেশনে দেখলাম ফেরিঅলারা হাঁক দিয়ে ঘোড়ার ডিম বিক্রি করছে। মোতালিব বলে, ‘বলছিস কী?’ আমি বলি নিজ কানে শুনেছি, ওরা বগিতে বগিতে গিয়ে বলছে ‘ঘোড়ার ডিম লাগবে? ঘোড়ার ডিম?’
মোতালিব হো হো করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে তার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। সে বলে, ‘ওরে গর্দভ। ওরা ওখানে গরম ডিম বিক্রি করছিল। সেদ্ধ করা ডিম। ফেরিঅলারা ওদের স্টাইলে উচ্চারণ করে ‘গ্রাম ডিম গ্রা...ম ডি....ম।’
কৃষিবিদ মনোজ মনোহর শ্রেষ্ঠ লিখেছেন, তাহলে নিজ কানে শুনে বিশ্বাস করবে-গুরুজনের এই উপদেশ কতটুকু নির্ভরযোগ্য। চাঁদনী রাতে পথে পড়ে থাকা দড়িকে সাপ ভেবে মানুষ ভয়ার্ত হয়, তখন নিজ চোখকে আমরা কোন যুক্তিতে ভরসা করি?
‘নিজের চোখে দেখেছি, নিজ কানে শুনেছি’ ঘোষণাপূর্বক কেউ যখন কোনো ঘটনার বিবরণ দেয় তখন তাকে মিথ্যুক মনে করা যায়? সব সময় যায় না। ‘১৯৭১ সালে আমার নিজ শহরে পাকিস্তানি মিলিটারির দখলদারি শুরু হলে খানপুর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বিখ্যাত ফুটবলার (পরে রেফারি) সাইফুল্লাহ, আমাদের প্রিয় বাচ্চু ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকি। তাঁর স্ত্রী ‘টুনি ভাবি’ আদরযতেœর কোনো সীমা রাখেননি। ভুঁইয়া বাড়ির অতিথি আমি, এলাকার মানুষ সে জন্য খুব সমীহ করে। বাচ্চু ভাইয়ের শ্যালক সালাহউদ্দিন এক সন্ধ্যায় আমাকে স্থানীয় বাজারে নিয়ে গেলেন। আমরা একটা চা-দোকানে ঢুকলাম। হাটবার ছিল, তাই দোকানে ক্রেতা যেন গিজ গিজ করছে।
অধিকাংশ ক্রেতার কণ্ঠে আফসোস ধ্বনি-‘হায়রে! অদুদ কমেন্টার। (কমান্ডার আবদুল ওয়াদুদ গ্রামাঞ্চলে সদ্য গড়ে ওঠা মুক্তিসেনা দলের অধিনায়ক) ক্যামনে এমন ভুল কইল্লেন! কার বুদ্ধিতে হ্যাতেন বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় মেলেটারি ক্যাম্পের সামনে গেলেন।’ একজন বলেন, ‘হোরন কাগা (ফোরকান কাকা), অদুদ সাবরে মাইরা ফালাইছে কে দেখছে?’ হোরন জানান, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে বালুর স্তূপে পড়ে রয়েছে গুলিতে ঝাঁজরা হওয়া কমেন্টার অদুদের নি®প্রাণ দেহ। শ্রোতারা সমস্বরে বলেন, শহীদি দরজা পাইবেন কমেন্টার। ইয়া গফুরুর রাহিম তুমি উনারে কবুল কর। বেহেশত নসিব কর।
আবদুল ওয়াদুদ কমান্ডার আমার বাল্যসখা তাজুল ইসলাম শান্নুর মামা। ভদ্রলোক সব সময় ফুটানি করতেন। তাসের আড্ডায় ছিলেন পারঙ্গম। চমৎকার বাঁশি বাজাতেন। সুঠামদেহী। সাঁতরে ৫০০ ফুট দীর্ঘ পুকুরের এপাড়-ওপাড় করতেন দম বন্ধ করে। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ওয়াদুদ এপ্রিলের গোড়ার দিকে গা-ঢাকা দেন। তিনি ‘কমেন্টার’ হয়েছেন, এই সংবাদে জেলা শহরটির পূর্ব দিক এলাকা বিস্ময়মাখা গৌরবে উল্লসিত। তাঁর মৃত্যুসংবাদ বহুজনের সঙ্গে আমাকেও গভীর বেদনায় জর্জরিত করে। ভুঁইয়া বাড়ির সুস্বাদু খাবারগুলো গলা দিয়ে নামতে চায় না।
দিন কয়েক পরে ফের ওই বাজারে যাই। সেদিনও ছিল হাটবার। চা-দোকানে লোক গিজগিজ করছে। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘চলেন তালতো ভাই, পিছনে গিয়া বসি। ওই দিকে মানুষ কম।’ গেলাম পেছনের কামরায়। দেখি টেবিলে টেবিলে বড় বড় সাইজের কুপিবাতি জ্বলছে। আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম। পেয়ালায় দুতিন চুমুক দিয়েছি, এমন সময় টেবিলে রাখা কুপিবাতিটা তুলে ঠোঁটে রাখা সিগারেট ধরাতে থাকেন দাড়িগোঁফঅলা একজন। তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চমকে উঠি। তিনি সহাস্যে বললেন ‘অ! আমার মরণের খবর তাইলে তুমিও পাইছ, না?’
ফিসফিস করে সালাহউদ্দিনকে জানাই, ‘ইনিই ওয়াদুদ কমান্ডার।’ কমান্ডারকে জানাই, ‘এ হচ্ছে টুনি ভাবির ছোট ভাই।’ কমান্ডার তাঁর ঠোঁটের ওপর তর্জনী চেপে ধরলেন। বুঝলাম, এখানে উল্লাস করা বারণ। নিঃশব্দে আমরা তিনজন বেরিয়ে এলাম চা-দোকান থেকে। কমান্ডারকে নিয়ে যাচ্ছি ভুঁইয়া বাড়িতে।
পথিমধ্যে তিনি জানতে চান, তাঁকে জীবন্ত দেখে আমার কী অনুভূতি। জবাবে কী বলেছি, তা আজ আর হুবহু মনে পড়ে না। কমান্ডার ওয়াদুদ প্রশ্নটা এখন যদি করতেন তাহলে বলতাম, ‘হোরণ কাগা তোড়ায় ভরা ঘোড়ার ডিম উপহার দিয়েছেন। সে জন্য তাকে অভিবাদন।’
ননী মামা ‘তোড়ায় ভরা ঘোড়ার ডিম’ বাক্যটি কোথায় পেয়েছিলেন বলেননি। বহু বছর পর জানলাম, ওই কথাগুলো সুকুমার রায়ের সর্বশেষ বই ‘আবোল তাবোল’-এর এক কবিতার অংশ : ‘আদিমকালের চাঁদিম হিম/তোড়ায় ভরা ঘোড়ার ডিম/ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর/গানের পালা সাঙ্গ মোর।।’ বইটি প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর (১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) ৯ দিন পর। মাত্র ৩৬ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। লক্ষণীয় পঙ্ক্তি-‘ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর।’ কেন এমন লিখলেন? মৃত্যু অত্যাসন্ন, কবি কি তা জানতেন?
♦ লেখক : সাংবাদিক