মুমিন জীবনে ইমানের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। ইমান নানাভাবে পরিপুষ্ট হয়। তন্মধ্যে একটি হলো, কাউকে পছন্দ-অপছন্দ করার মাপকাঠি হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটা ইমানের দাবি। রসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য দান করে এবং আল্লাহর জন্য দান করা থেকে বিরত থাকে, সে ইমান পরিপূর্ণ করেছে (আবু দাউদ)। রসুল (সা.) আরও বলেছেন, ইমানের সবচেয়ে মজবুত হাতল হলো, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)।
হাদিস দুটি ইমান পরিপূর্ণ হওয়ার একটি মানদণ্ড। কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা অত্যন্ত কম। পশ্চিমা ধ্যানধারণায় প্রভাবিত লোকেরা এ মানদণ্ডকে ইসলামের সংকীর্ণতা মনে করে। তারা ধর্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার সবক দেয় আমাদের। ইসলামও মানুষকে মানুষ হিসেবে বিশেষ সম্মান দেওয়ার কথা বলেছে। রসুল (সা.) ইহুদির লাশ দেখে দাঁড়িয়ে গেছেন। এটা ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে সম্মান দেখানোর সর্বোকৃষ্ট নমুনা। তবে পশ্চিমারা যে সম্মানের কথা বলে, তা উদ্দেশ্যমূলক। এর মাধ্যমে ব্যক্তির ধর্ম পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু থাকে না। তারা আমাদের ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠার কথা বলে সুকৌশলে আমাদের ধর্মের প্রাণশক্তি ও ইমানের দাবি শেষ করতে চায়। বস্তুত তথাকথিত মানববাদীরা নিজেরাও নিজেদের ধর্মীয় গণ্ডির সীমায় আবদ্ধ। তারাও ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। তারা যদি এতই উদার হবে, তবে তাদের হাতে কেন ফিলিস্তিনের রক্ত? উদারতার ধ্বজাধারী এ মানুষগুলোই ইসলামের প্রশ্নে সবচেয়ে সংকীর্ণতার পরিচয় দেয় আর মুসলমানদের উদার হওয়ার পরামর্শ দেয়। শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি আল্লাহ, এর অর্থ এই নয় যে আমাদের সব সহানুভূতি ও ভালোবাসা কেবল মুসলমানদের জন্য থাকবে। মানুষ হিসেবে অমুসলিমদের প্রতিও আমাদের সহানুভূতি থাকবে। কারণ ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি (সুরা ইসরা ৭০)। ইসলাম আমাদের উদারতার শিক্ষা দিয়েছে। তবে সেই উদারতার একটি মানদণ্ড আছে। আমরা সেই মানদণ্ডের ভিতরে থেকে উদার। উদারতার নামে আপন ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হওয়া ইসলামের শিক্ষা না। আমরা মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই দেখি না, আমরা মানুষকে দেখি আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে। আপনি যখন মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখবেন, তখন আপনার ভাবনায় স্রষ্টার ধারণা হাজির হবে না। কিন্তু মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে দেখলে এ দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর আল্লাহর অস্তিত্বের ধারণাও হাজির থাকে। এ দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটা উপকারিতা হলো, এর ফলে আমরা শুধু মানুষের প্রতিই সহমর্মী হই না, আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির প্রতিও সহমর্মী হয়ে উঠি। প্রথমটার তুলনায় এ ভাবনা অনেক বেশি প্রশস্ত এবং কল্যাণমুখী। রসুল (সা.) বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি একটি চড়ুই পাখি বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র কোনো কিছুকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তবে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে এ বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন (মুসতাদরাক আল হাকিম)।
এতে প্রমাণ হয়, ইসলাম শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীর প্রতিও সহানুভূতি প্রদর্শনের নির্দেশনা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আল্লাহর নিষ্প্রাণ কোনো সৃষ্টির সঙ্গেও স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ না করার বিষয়ে আমরা দায়িত্বশীল। এ কারণে একটি গাছের সঙ্গে, একটি নদীর সঙ্গে, মানুষ চলাচলের রাস্তার সঙ্গে যা খুশি তাই আমরা করতে পারি না। এটাই মুসলমানদের আচরণগত মানদণ্ড, যা অন্যদের মানদণ্ড থেকে অনেক বেশি যৌক্তিক, শক্তিশালী, মানবিক এবং সংবেদী। পশ্চিমারা আমাদের ইমানের ঊর্ধ্বে উঠে উদারতা শেখাতে চায়। এর কারণ, আমাদের ইমান নিয়ে তাদের বড় ভয়। তারা জানে, সারা বিশ্বের মুসলমানদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত যত মতপার্থক্যই থাকুক, ইমানের প্রশ্নে সবাই এক। এ ইমানি ঐক্যকে তারা ভয় পায়। এ জন্য উদারতার নামে মুসলমানদের ইমান সম্পর্কে উদাসীন বানাতে তাদের এত তৎপরতা। তাই উদারতার চোরাবালিতে পড়ে আমরা যেন কুফরির কিনারায় পৌঁছে না যাই, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
ইমানি ঐক্যের বিষয়ে রসুল (সা.) চমৎকার এক উদাহরণ দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের মতো। শরীরের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে সমস্ত শরীর বেদনা অনুভব করে। ঠিক তেমনি পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো এক মুসলমান বিপদগ্রস্ত বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার জন্য সব মুসলমানকে বেদনাহত হতে হবে। এটাই ইমানের দাবি। একজন মানুষ আফ্রিকায় বসবাস করে। তার ভাষা, গায়ের রং, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস- সবকিছুই আমার থেকে আলাদা। কিন্তু সে মুমিন হলে আমি তাকে তার ইমানের জন্য ভালোবাসব। আবার আরেকজন আমার পরিবারের সদস্য হলেও সে যদি ইসলামের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করে, তবে তাকে আমি অপছন্দ করব। এটাই আল্লাহর জন্য কাউকে পছন্দ কিংবা অপছন্দ করা।
ইমানের অনালোচিত এ বিষয় নিয়ে আমাদের নতুন পাঠ ও পর্যালোচনার সময় এসেছে।
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ