বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রাণ নেই, মান নেই চলচ্চিত্রের গানে

প্রাণ আর মান হারিয়েছে চলচ্চিত্রের গান। ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকের মতো এখনকার গানের কথা ও সুর দর্শকহৃদয়ে সাড়া জাগাতে পারছে না। তখনকার গানগুলো এখনো গুনগুন করে শ্রোতারা। গীতিকার কে জি মোস্তফার লেখা এবং তালাত মাহমুদের কণ্ঠে ষাটের দশকে এহতেশাম নির্মিত ‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রের গান ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’ কিংবা একই গীতিকারের সত্তরের দশকে অশোক ঘোষ নির্মিত ‘নাচের পুতুল’ চলচ্চিত্রের গান ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে’ আজও জনপ্রিয়। কে জি মোস্তফা ছাড়াও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আমজাদ হোসেন, আহমেদ জামান চৌধুরী, রফিকুজ্জামানসহ আরও অনেকের লেখা গান চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে আছে। আশির দশকের পর থেকে কৌলীন্য হারিয়েছে দেশীয় চলচ্চিত্রের গান। কিন্তু কেন? এর কারণ বর্ণনা করেছেন কয়েকজন সংগীতকার। তাদের কথা তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

চলচ্চিত্রের গানে-গল্পে ছিল জীবনের ছায়া

কে জি মোস্তফা

গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাব্যময়তা ও মেলোডি। এখন তা কোথায়? আগে গান লিখতে  পড়ালেখা করতে হতো। যারা সাহিত্যচর্চা করত তারাই গান, গল্প লিখত। এখন ইচ্ছা করলেই যে কেউ গীতিকার-গল্পকার হয়ে যেতে পারছে। বিষয়টি যেন একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে এখন সাহিত্যনির্ভরতাকে বাদ দিয়ে বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আগে চলচ্চিত্রের গান-গল্পে জীবনের ছায়া খুঁজে পাওয়া যেত। এখন তো গান মানে ফান। উচ্চলয়ে যন্ত্র বাজতে থাকে। গানের কথা বোধগম্য হয় না। তাই শুরুতেই শেষ হয়ে যায় এসব গান। এখন গানের ক্ষেত্রে যন্ত্রই প্রধান যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার করতে হবে, লাফালাফি করতে হবে, না হলে গান হবে না। এখনকার গানে মেলোডি, কাব্যময়তা, জীবনবোধ, শিক্ষা এবং গভীরতা বলতে কিছু নেই। তাই এখনকার গান সহজে হারিয়ে যাচ্ছে।

 

গানের কথা ও সুরে নেই গভীরতা

আমজাদ হোসেন

বর্তমানে গানের মৌলিকত্ব দুঃখজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাই এখনকার গান আর শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছে না। এর অনেক কারণ রয়েছে। যোগ্য গীতিকার ও সুরকারের অভাব। গানের কথা ও সুরে এখন মেলোডি এবং জীবনবোধের অভাব, কথা ও সুরে গভীরতা নেই। মান ও প্রাণহীন গান শ্রোতারা গ্রহণ করবে কেন? এখন আর সানাই, সেতার, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়ামসহ কোনো অ্যাকোয়িস্টিক ব্যবহার করা হয় না। এখন সবই

কি-বোর্ডনির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেই গান লিখে ফেলতে পারছে।  মানে গান লেখা, সুর করা এবং কণ্ঠ দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। চাইলেই যে কেউ গান লিখতে আর সুর করতে পারছে।

মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু সহজলভ্য হয়ে গেলে তার মান আর থাকে না। চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে এখন তাই হয়েছে।

 

তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিবর্ণ হচ্ছে গান

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

চলচ্চিত্রের গল্প টেনে নিতে গানের প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় ধরে গল্প দেখতে দেখতে দর্শক যখন ঝিমিয়ে পড়ে তখন বিনোদনের জন্য গানের আগমন ঘটতে হয়। দর্শক রিল্যাক্স ফিল করে। গল্প ও সিকোয়েন্সের প্রয়োজনেই চলচ্চিত্রে গানের আয়োজন হয়। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত গান নিয়ে নির্মাতারা রীতিমতো গবেষণা করত। গানের কারণে সিকোয়েন্স হতো। এখন বলা হয় সিচিউশনের জন্য গান দরকার। এটি আসলেই অবক্ষয়। এখন লেখা, সুর দেওয়া আর গাওয়া যার যার মতো করে চলছে। এক্ষেত্রে ব্যাকরণের ধার ধারা হচ্ছে না। তাই গানের স্থায়িত্ব বা মান বলে কিছুই থাকছে না। তা ছাড়া এখন সব কিছুই আধুনিক হয়ে পড়ছে। এই আধুনিকতার কারণে সব কিছুতেই পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন ভালো হলে তাকে মন্দ বলব না। কিন্তু সংগীতশিল্প এখন তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে।

 

গানকে জীবন ও আত্মার কাছে নিয়ে যেতে হবে

শহীদুল্লাহ ফরায়েজী

সংগীত হচ্ছে আত্মার খোরাক। মানুষের ভিতর যতদিন আত্মা ও হৃদয় থাকবে ততদিন সংগীত থাকবে। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না। আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়া যায় না— সেই গান অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী। অমরত্বের জন্য গানকে হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে রচনা করতে হবে। কারণ সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। চলচ্চিত্রের গান একসময় ছিল জীবনমুখী ও নৈতিকতাপূর্ণ। গল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, মাখামাখি পূর্ণ। তাই চলচ্চিত্রের সেই গান মানুষের হৃদয়কে দোলা দিত, তাড়িত করত। সেই অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে চলচ্চিত্রের গানকে আবারও জীবন ও আত্মার কাছে নিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

 

এখন এক বসাতেই গান গেয়ে ফেলা হচ্ছে

খুরশীদ আলম

গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার বিষয়। এখন গুরুর কাছেও কেউ দীক্ষা নেয় না। সাধনাও করে না। তাই শুধু চলচ্চিত্রের গান নয়, সব গানই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আগে একটি গান তুলতে কয়েক মাসও সময় লেগে যেত। কথা, সুর, গায়কী নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। আর এখন মুহূর্তে লেখা থেকে শুরু করে এক বসাতেই গেয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই এসব গান আর প্রাণ ছুঁতে পারছে না। মানে আঁতুড় ঘরেই গানের মৃত্যু হচ্ছে। এখন একেবারেই যে ভালো গান হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। এর পরিমাণ নিতান্তই স্বল্প। এই স্বল্পতা দিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতকে ধরে রাখা যাবে না। একসময় চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের প্রয়োজনে চলচ্চিত্র হয়। এই অবস্থার জন্যই চলচ্চিত্রের গানের অবস্থা নাকাল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণে ওই যে বললাম গুরুর দীক্ষা আর সাধনা অত্যন্ত জরুরি।

সর্বশেষ খবর