কেউ কথা রাখেনি; লকডাউনের মধ্যেও চলছে নাটকের শুটিং। করোনা সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে এবং শোবিজের সদস্যদের নিরাপদ রাখার স্বার্থে বিগত ২২ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব শুটিং বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় নাটক-সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। কিন্তু এই ঘোষণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছে শুটিং। অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে ক্যামেরা ইউনিট, নির্মাতা, প্রোডাকশনের লোকজন নিয়ে শুটিং হাউসে বসেছে ঈদ নাটক নির্মাণের মহোৎসব। যা এই করোনাকালে সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ। নাট্যসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এমন কর্মকান্ড।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল পূবাইলের হাসনাহেনা শুটিং হাউসে ঈদের জন্য ৭ পর্বের ধারাবাহিকের শুটিং হয়। এনটিভির জন্য নির্মিত এই ৭ পর্বের কাজটি নির্মাণ করছেন আদিবাসী মিজান। ক্যামেরায় আছেন আনোয়ার হোসেন বুলু, যার এই করোনা সংকটেও ২০ তারিখ পর্যন্ত শুটিং সিডিউল লক! নাটকটি প্রযোজনায় প্রোডাকশন হাউস ক্রাউন এন্টারটেইনমেন্ট। নাটকটিতে অভিনয়ের তালিকায় রয়েছেন দেশের জনপ্রিয় সব তারকামুখ। শুটিং করার জন্য সে সময় উপস্থিতও ছিলেন জাহিদ হাসান, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, মনিরা মিঠু, আইরিন আফরোজসহ অনেকেই। যেখানে এই করোনার সময় মানুষ ঘরবন্দী ও শুটিং-সংশ্লিষ্ট সব কাজ বন্ধ, সেখানে কীভাবে সবকিছুকে উপেক্ষা করে শুটিং হচ্ছে?বিষয়টি জানতে নির্মাতা আদিবাসী মিজানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি থতমত খেয়ে যান। এরপর পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেন, ‘ভাই, আমি শুয়ে আছি। এই লকডাউনের মধ্যে আবার শুটিং কে করবে? আমি শুটিং করছি না। আমি তো অনেক আগেই ৭ পর্বের ৬টি কাজ করে রেখেছি। সেগুলোই ঈদে প্রচার হবে।’ কিন্তু তিনি বিষয়টি অস্বীকার করলেও আমাদের বিশ্বস্ত সূত্র মতে শুটিং চলার ঘটনা ছিল সত্য। এ বিষয়ে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি ও জনপ্রিয় অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা হয়। শুটিং যে হয়েছে সেটি নিশ্চিত করে বলেন, ‘হুম, শুটিং চলছিল; পরে আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। জাহিদ, বুলু ভাইসহ প্রোডাকশনের সবার সঙ্গে কথা বলেছি।’ কিন্তু এমন সংগঠন পরিপন্থী কাজে কি পদক্ষেপ নেবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করেছি। তারা তো ভুল স্বীকার করেছেন। তৎক্ষণাৎ শুটিং বন্ধ করে চলে গেছে। পরবর্তীতে ১৪-১৫ তারিখের পর কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হব। আমরা সবাই শুটিং করতে পারব কিনা।’
এদিকে এনটিভির প্রোগ্রাম হেড মোস্তফা কামাল সৈয়দ অসুস্থ থাকায় এ বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে এনটিভির প্রোগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘ঈদের জন্য আমাদের এখানে কিছু নাটক প্রচার হবে, একক নাটক প্রায় ২১টা। আমাদের ইনহাউসের কিছু কাজ করা ছিল আর কিছু এজেন্সি থেকে নেওয়া হচ্ছে। একটি ৭ পর্বের কাজ হওয়ার কথা, যার নির্মাতা আদিবাসী মিজান। তবে তার শুটিং হচ্ছে কিনা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।’
দেশের অনেক চ্যানেলই এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। যেখানে বাংলাভিশন, আরটিভি, এটিএন বাংলাসহ বেশির ভাগ চ্যানেল পুরনো নাটক দিয়ে ঈদ উৎসবকে সাজিয়েছে, সেখানে এই করোনাকালে এনটিভির মতো চ্যানেল কেন নতুন নাটক ঈদ সিডিউলে যুক্ত করেছে? এটি রীতিমতো রীতিবিরুদ্ধ। বাংলাভিশনের প্রোগ্রাম হেড তারেক আখন্দ বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রচারিত কাজগুলো আগের। শুধু চাঁদরাতে মমতাজের একটি গানের অনুষ্ঠান যাবে; তবে সেটি করা হবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে।’
অন্যদিকে আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান বলেন, ‘আমাদের এবারের সব কাজই নভেম্বর ও ডিসেম্বরে করা। এদিক দিয়ে আমরা লাকি। পারিপার্শ্বিকতা ও দর্শকদের কথা চিন্তা করে আমরা এই কাজগুলো করেছি। এ সময় করোনা রিলেটেড কিছু নাটক প্রচার হচ্ছে, যেগুলো লকডাউনের আগে থেকেই তৈরি করা।’
এদিকে নাট্যনির্মাতা মোহন খান নতুন ১০টি একক নাটকের কাজ বিভিন্ন চ্যানেলে জমা দিয়েছেন। খবরটি পেয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ঈদে নতুন ও পুরনো মিলে মোট ১০টি একক নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হবে।’ কিন্তু নতুন নাটকগুলো কি লকডাউনের আগে না পরে করা, প্রশ্ন করলে তিনি এর স্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেননি। এর আগেও চলমান লকডাউনের মধ্যে রাজধানীর মগবাজারে একটি মিউজিক ভিডিওর শুটিং করায় ফুটেজ জব্দ করে সংশ্লিষ্টদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছিল। সে সময় সরকারের ‘সাধারণ ছুটি’র সঙ্গে সমন্বয় রেখে ১৬ মে পর্যন্ত শুটিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৫ সংগঠন। সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কেন হরহামেশাই এই শুটিং হচ্ছে? ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক তখন জানিয়েছিলেন, শুটিংয়ে মিউজিক ভিডিওর শিল্পী ও কলাকুশলী মিলিয়ে ৮ জনের মতো ছিলেন; তবে সেখানে নাটকের কোনো শিল্পী ছিলেন না।’
ঈদকে কেন্দ্র করে লুকিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে, যেগুলোর খবর অনেক সময় সংগঠনের অগোচরে থেকে যায়।
ঈদেও বিটিভি কিছু ইনহাউস শুটিং করেছে। বিটিভি ছাড়াও কিছু চ্যানেল ও নয়া ইউটিউবাররা নিজস্ব চ্যানেলে ভিউ বাড়াতে লুকিয়ে বানাচ্ছে কনটেন্ট। অনেকে ঘরোয়াভাবে শুটিং চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনার এ সময় সেগুলোর শুটিং করা কতখানি যৌক্তিক? তবে শিল্পীদের এমন অযাচিত কা- কারোই কাম্য নয়।
তারা মুখে রীতিনীতির কথা বললেও তাদের কাজে-কর্মে অন্য পরিচয় দেওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর থেকে উত্তরণ হবে কবে? এ প্রশ্ন এখন মিডিয়াসহ সর্বস্তরের সচেতন মানুষের।