প্রখ্যাত অভিনেতা রহমানের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। শবনমের সঙ্গে জুটি বেঁধে হয়ে যান তুমুল জনপ্রিয় একজন নায়ক। তখন তার অভিনয়ের স্বতন্ত্র স্টাইল এবং ফ্যাশন দর্শকদের মন্ত্রের মতো সিনেমা হলে টেনে নিয়ে যেত। রহমানের ছবি মানেই ছিল ‘রহমান-শবনম’ জুটি। প্রয়াত এই কিংবদন্তি অভিনেতার স্মরণে তার সহশিল্পী শবনমকে নিয়ে আজকের আয়োজন তৈরি করেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি জুটি
পঞ্চাশের দশক থেকে ওপার বাংলার চলচ্চিত্রে সাড়া জাগিয়ে দর্শকমন তোলপাড় করেছেন উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন জুটি। তাদের মুগ্ধতা এপার বাংলার দর্শকদেরও মাত করে রেখেছে। এমন একটি সময়ে ঢাকাই ছবিতে কোনো জনপ্রিয় জুটি গড়ে ওঠেনি। অবশেষে ষাটের দশকে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এদেশের চলচ্চিত্রের তারকা তৈরির কারিগর খ্যাত দুই সহোদর নির্মাতা এহতেশাম-মুস্তাফিজ জুটির হাত ধরে এলেন দুই নতুন মুখ। রহমান-শবনম। মুস্তাফিজের ‘হারানো দিন’ ছবিতে প্রথম শবনম-রহমান জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রে ‘মালা’ চরিত্রে শবনম আর ‘কামাল’ চরিত্রে রহমান। ছবিটি ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়। এ ছবির মাধ্যমে রহমান-শবনম জুটি তখন খ্যাতির তুঙ্গে। ঠিক সেই সময়ে তাদের উর্দু ছবিতে কাস্ট করলেন এই পরিচালক ভ্রাতৃদ্বয়। এ জন্য রহমানকে কিছুদিন উর্দু শিখতে হলো। ১৯৬২ সালে এহতেশামের ‘চান্দা’ আর ১৯৬৩ সালে মুস্তাফিজের ‘তালাশ’ ছবিতে অভিনয় করে এ জুটি আরও হিট হয়ে গেল। ওপার বাংলার উত্তম-সুচিত্রার মতো এপার বাংলায় কিংবদন্তি হয়ে গেলেন শবনম-রহমান জুটি।
রহমান যেভাবে চলচ্চিত্রে
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়া ও অভিনেতা অসিত বরণের ভক্ত ছিলেন রহমান। প্রিয় শিল্পীদের অভিনয় দেখতে সন্ধ্যা হলেই ছবিঘরে ছুটে যেতেন। সিনেমা দেখতে দেখতে এক সময় অভিনয় করার ভূত চেপে বসে মনে। কাউকে কিছু না বলেই সিনেমার টানে বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন। এখান থেকে আইএ পাস করলেন। ১৯৫৮ সালে শাহবাগ হোটেলে চাকরি নেন। ইংরেজি ও হিন্দি ছবি মুক্তি পেলে হলে গিয়ে দেখতেন। সুচিত্রা-উত্তমের সাগরিকা, শাপমোচন, শিল্পী ছবি দেখে চলচ্চিত্র জগতের প্রতি আগ্রহটা আরও বেড়ে যায়। এক সাক্ষাৎকারে রহমানের কথায়, শাহবাগ হোটেলে রিসিপশনিস্টের চাকরি করি। সেখানে আমাকে কয়েকজন বন্ধু ঠাট্টা করে উত্তম উত্তম বলে ক্ষেপাত। এক দিন আমার একজন বন্ধু এসে বলল, আমাদের এখানে ছবি তৈরি হবে সেখানে সুযোগ পেতে পারিস। বন্ধুদের কথা মতো গেলাম সেই অফিসে। পরিচালকের নাম ফজলুল হক। ছবির নাম ‘আজান’। রমনা পার্কের পশ্চিমে টেনিস গ্রাউন্ডের সঙ্গে ছোট একটা রুমে অফিস। পরিচালক হক সাহেবের স্ত্রী আমাকে দেখে বললেন, ‘আমি মনে মনে নায়কের ভূমিকায় যে রকম মুখ খুঁজছিলাম ঠিক সেই রকম ছেলে আল্লাহ পাঠিয়েছে।’ সে দিনই আমাকে নায়ক চরিত্রে নির্বাচন করলেন হক সাহেব। তখন আমার বয়স ১৯ বছর। আমার উচ্চারণে কিছুটা সমস্যা ছিল। তাই বিরোধিতা করেছিলেন অভিনেতা ইনাম আহমেদ। সে দিন যে আমাকে উৎসাহ, অভয়, সাহস ও সহযোগিতা করেছিল তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় চিত্রগ্রাহক প্রয়াত সাধন রায়। এরই মধ্যে এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ এ অভিনয় করার সুযোগ পাই।
এহতেশাম ‘উত্তম কুমার’ ডাকতেন
এহতেশাম শাহবাগ হোটেলে প্রায়ই আসতেন। তার সঙ্গে রহমানের ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় অল্প দিনেই। তিনি তাকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অফার দেন। এহতেশামের অফার পেয়ে তো রহমান আহ্লাদে আটখানা। তিনি রহমানকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, তুমি দেখতে অবিকল উত্তম কুমারের মতো।
ছবির সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলেন
এহতেশাম পরিচালিত ছবি ‘এদেশ তোমার আমার’ এ প্রথমদিন শুটিংয়ে অংশ নিয়ে অভিনয় করতে পারছিলেন না। বারবার ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখে খান আতা বললেন, এহতেশাম এই ছেলেটাকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন। একথা শুনে রহমান শুটিং স্পষ্ট থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার একটু আসি কথাটি শুনে সন্দেহ হয় সেটের সবার। রহমান পালিয়ে যেতে পারলেন না। ‘এদেশ তোমার আমার’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। এ ছবিটি হিট হয় একই সঙ্গে রহমানের অভিনয় প্রশংসিত হয়।
রহমানের অন্য যত হিট ছবি
১৯৬৫ সালের ১৬ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘বাহানা’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জহির রায়হান ছবিটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র ব্যাপক জয়প্রিয়তা এনে দেয় নায়ক রহমানকে। তার আগের চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ব্যাপক জয়প্রিয় ছিল তৎকালীন দুই পাকিস্তানে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। সেখানে নায়ক রহমান চুনি লালের চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৮১ সালে দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘অংশীদার’ চলচ্চিত্রেও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। রহমান অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ছিল অশোক ঘোষ পরিচালিত নব্বইয়ের দশকে মুক্তি পাওয়া ‘আমার সংসার’।
নির্মাতা হিসেবেও সফল
অভিনয়ের পাশাপাশি রহমান বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক, যিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। ১৯৬৭ সালে ‘দরশন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন তিনি। ‘দরশন’ আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। এ ছবিতেও তার নায়িকা ছিলেন শবনম। রহমান পরিচালিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো, ‘মিলন’, ‘কঙ্গন’, ‘যাহা বাজে সেহনাই’, ‘নিকাহ’ প্রভৃতি।
‘দরশন’-এর সফলতা
রহমান পরিচালিত সাদাকালো চলচ্চিত্র ‘দরশন’ মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। রোমান্টিক ও মিউজিক্যাল ঘরানার চলচ্চিত্রটির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন নায়ক রহমান। চলচ্চিত্রটি সুপার হিট হয়। রহমানের স্ত্রী কুমকুম প্রযোজিত এ চলচ্চিত্রটি রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকার চমৎকার লোকেশনে চিত্রায়িত হয়। গান ও দৃশ্যায়নের জন্য ‘তুমারে লিয়ে ইস দিল মে’ গানটি এর ভালো উদাহরণ। লেকে নৌকা চালাতে চালাতে গানটি শোনা যায় রহমানের কণ্ঠে। নৌকার অন্য সওয়ারি শবনম। এমন নির্জনতায় বসে গান গাওয়াতে সাধারণত ধীরলয় আশা করা হয়। কিন্তু গানটি সব নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে দেয়, লাউডলি মনের কথা বলে। অন্যদিকে স্লিভলেস ব্লাউজ আর শাড়িতে শবনম পুরো বিষয়টি উপভোগ করেন। ‘ইয়ে মওসম ইয়ে মাস্ত নাজারে’ গানটিও একইভাবে নৌকায় একাকী গাইছেন রহমান। শবনম একটি বাড়ির লনে আধুনিক আউটফিটে বসে আছেন। কোনো পাহাড়ি গ্রামে বেড়াতে এসে গরিব নৌকা চালক রহমানের প্রেমে পড়েন ধনীর মেয়ে শবনম। চলচ্চিত্রের কাহিনিও তা-ই। শহুরে মেয়ে বেবি ও গ্রামের ছেলে হীরার প্রেম কাহিনি। এক সময় হীরাকে বেবি শহরে নিয়ে যায়। হীরা দেখতে পায় শহর তার ভিতর থাকা সব ভালোত্বকে কেড়ে নিচ্ছে। বিনিময় পাচ্ছে শুধু ছলনা। হীরা ফিরে আসে গ্রামে। পিছু পিছু আসে শবনম। এবার তার পরনে গ্রামীণ পোশাক। শহরকে ঘোরতরভাবে সমালোচনা করে চলচ্চিত্রটি। সব শ্রেণির দর্শক মন ভীষণভাবে নাড়া দেয় রহমান-শবনম জুটির অনবদ্য প্রেমের ছবি ‘দরশন’। পাকিস্তানের দুই অংশে বাংলা কিংবা উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে রহমান শবনম জুটি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। এই জুটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রথম জনপ্রিয় ও সার্থক জুটি।
যেভাবে পা হারালেন রহমান
‘প্রীত না জানে রীত’ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে শুটিং করার জন্য রহমান গেলেন সিলেটে। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই রহমান এক পা হারালেন। সেদিন সিলেটে জিপগাড়ি চালাচ্ছিলেন আফজাল হোসেন। পাশে মোহসীন নজরুল বসা। রহমানের এক পা ছিল বাইরে। মুরারী চাঁদ কলেজের সামনে আসতেই একটি ট্রাক এসে রহমানের এক পা কেড়ে নিল। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৬ মাস, লন্ডনে ৪ মাস চিকিৎসার পরও পা ফিরে পেলেন না।
পশ্চিম পাকিস্তানেও সফল জুটি
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে রহমান ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন পাকিস্তানে। তারপর তার স্ত্রী কন্যারাও চলে গেলেন করাচিতে। বছর দুই করাচিতে কাটিয়ে অবশেষে লাহোরে গিয়ে ১৯৭৪ সালে ‘ফাহাদ’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করেন। নায়ক রহমান নায়িকা শবনম। ‘ফাহাদ’ সুপারহিট হলো পশ্চিম পাকিস্তানে।
এক নজরে রহমান
বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয় অভিনেতা রহমান অভিনীত উল্লেখ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো উর্দুতে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মিলন’, ‘বাহানা’, ‘ইন্ধন’, ‘দর্শন’, ‘জাঁহা বাজে সেহনাই’, ‘গোরি’, ‘প্যায়াসা’, ‘কঙ্গন, ‘দোস্তি’, ‘নাদান’; বাংলায় ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘এই তো জীবন’, ‘হারানো দিন’, ‘যে নদী মরু পথে’, ‘দেবদাস’। রহমান ছিলেন ৫ কন্যার জনক। তিনকন্যা আমেরিকা প্রবাসী, এক কন্যা লন্ডনে এবং সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা থাকেন ঢাকায়। শেষ জীবনে ঢাকাতেই কাটে তার অসুস্থ জীবন। হুইল চেয়ারই হয় তার চির সঙ্গী। এই অসুস্থ কিংবদন্তি অভিনেতার খবর নিতেন না চলচ্চিত্রে কেউ। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাসসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন রহমান। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই ঢাকায় এই কিংবদন্তি দাপুটে অভিনেতার জীবনাবসান ঘটে। চলচ্চিত্রামোদীদের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের উত্তম কুমার খ্যাত অভিনেতা রহমান।