মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

৪৯ বছরেও নেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র

৪৯ বছরেও নেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র

স্বাধীন দেশে ৪৯ বছরেও নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। “দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’ মোটেও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নয়। এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের খ-চিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। তাই এটিকে আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ডকুফিল্ম বলব।” বলেছেন নির্মাতান্ডঅভিনেতা মাসুদ পারভেজ। বিষয়টি তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্য, স্বল্প এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ও ইতিহাসভিত্তিক কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক  যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠেনি। খ-চিত্র নিয়েই ছবিগুলো নানা আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমানের কথায় ‘মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় অংশ ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি এ পর্যন্ত নির্মিত কোনো চলচ্চিত্রেই দেখানো হয়নি। এসব ছবিকে মোটেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ চিত্র বলা যায় না।  চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাধীন দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এর প্রযোজক চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা বলেন, ‘ওরা ১১ জন’ মোটেও চলচ্চিত্র নয়। এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের খ-চিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। তাই এটিকে আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ডকুফিল্ম বলব।’ চলচ্চিত্র নির্মাতা  মোরশেদুল ইসলামের মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধ মানে বিশাল পরিসর। এর ব্যাপ্তিকাল একসঙ্গে একটি  সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরা অসম্ভব। এর কারণ সীমাবদ্ধতা। চাইলেই আসল অস্ত্রশস্ত্র, সে সময়ের আবহ-পরিবেশ থেকে শুরু করে  কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। তাছাড়া বাজেটও এক্ষেত্রে একটি বড় ফ্যাক্টর। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আংশিক ঘটনা নিয়ে খ-চিত্র নির্মাণ করা যায়, যাকে কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্র বলা যাবে না।’ চলচ্চিত্র গবেষক সাংবাদিক অনুপম হায়াৎও এ পর্যন্ত নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো চলচ্চিত্রকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বলতে রাজি নন। তাঁর বর্ণনায়- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি হয় ১৯৭১ সালে কলকাতায়। ওই সময় চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এগুলো ছিল জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন, আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার্স ও বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস। এসব ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ত্বরান্বিত করা। জহির রায়হান এই চারটি প্রামাণ্যচিত্রের নামকরণ করেছিলেন ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’। ১৯৭২ সালে শত্রুমুক্ত পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় নতুন উদ্যমে। সেই থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম কাহিনিচিত্র ওরা ১১ জন (১৯৭২) নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ওরা ১১ জনে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের বিভিন্ন অপারেশন চিত্রিত হয়েছে। ছবির নামটি প্রতীকী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টর এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার অনুসরণে ছবির নামকরণ করা হয়েছে। এই চিত্রে নারী নির্যাতন, মায়ের আত্মত্যাগ, কিশোর মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণ, কন্যা কর্তৃক রাজাকার পিতা হত্যার দৃশ্য রয়েছে। চাষী নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো সংগ্রাম (১৯৭৩)। এই ছবির কাহিনি গড়ে উঠেছে   সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের ডায়েরি অবলম্বনে। এতে ইস্ট  বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য বাহিনীর বীরত্বগাথা চিত্রিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আরেক সার্থক চিত্র সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)। কাহিনি গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধযুদ্ধ এবং এক ধর্ষিত নারীকে একজন অভিনেতা কর্তৃক স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ নিয়ে। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরের প্রথম কাহিনিচিত্র ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)। এতে প্রামাণ্য ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটেছে। যুদ্ধউত্তর পরিবেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অবক্ষয় ধরা পড়েছে খান আতাউর রহমানের আবার  তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) ও নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল (১৯৭৪) চিত্রে। মুক্তিযুদ্ধের যে চলচ্চিত্রটির চিত্রভাষা মানবিকতা ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে, সেটি হলো হারুনর রশীদের মেঘের অনেক রং (১৯৭৬)। এই চিত্রে রয়েছে যুদ্ধের সময় রুমা নামের এক ডাক্তারের স্ত্রী ধর্ষণের পর সন্তানসহ কীভাবে কষ্টের শিকার হয় তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা। একই পরিচালকের আরেকটি ছবি আমরা তোমাদের ভুলব না (১৯৯০) আবর্তিত হয়েছে মতলব নামের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের কাহিনি নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন একাত্তরের যিশু (১৯৯৩) এবং গেরিলা (২০১১)। দুটো চিত্রই বাস্তবতা ও শিল্পবোধে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের খ-চিত্র মাত্র। সাহিত্যিক, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমণি (১৯৯৫) আবর্তিত হয়েছে ঢাকা শহরের রুদ্ধ পরিবেশে একটি পরিবারের আতঙ্ক এবং বদি নামের এক গেরিলার অপারেশন ও শহীদ হওয়ার ঘটনা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র আগামী (১৯৮৪) নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। তিনি পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) ও অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫) নির্মাণ করেন। তাঁর তিনটি চলচ্চিত্রই মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়গ্রাহী খ- দলিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একেবারে আলাদা ধরনের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ মুক্তির গান (১৯৯৫) এ। এই চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলের কার্যক্রম সার্থকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেলের পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬) এবং তৌকীর আহমদের জয়যাত্রা (২০০৫) মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি নারীবাদী চলচ্চিত্র হচ্ছে শামীম আখতারের ইতিহাস কন্যা (১৯৯৯)। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও কটি আলোচিত খ-চিত্র নির্মিত হয়েছে- যেমন বাপজানের বায়োস্কোপ, লাল-সবুজের দীপাবলি (প্রামাণ্য), ১৯৭১ (প্রামাণ্য), প্রত্যাবর্তন (স্বল্পদৈর্ঘ্য) ইত্যাদি। বাণিজ্যিক ধারার নির্মাতারা এখন মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে তেমন আগ্রহ দেখান না। বড়জোর প্রসঙ্গক্রমে হালকাভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কে  টেনে আনেন। এর কারণ সম্পর্কে চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহ আলম কিরণের বক্তব্য হলো- ‘আমাদের এখানে রাজনীতিকীকরণ খুব বেশি। যে যখন ক্ষমতায় থাকে সে তখন নিজেদের সম্পৃক্ততাকে দেখানোর চেষ্টা করে।  যেমন- আমাদের দেশে একটা ওপেন বিতর্ক হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাকে দিয়েছে। এসব মতবিভেদ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর বিপক্ষের শক্তির বিতর্কে পরিচালকরা জড়াতে চান না। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ কম হওয়ার এটিও বড় একটি কারণ। এমন অভিযোগও রয়েছে যে, চলমান  কোনো সরকারের সময় মতাদর্শের ভিন্নতা হলে সেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড় পায় না। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের কথায়, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে গল্প বলার জন্য যে  মেধা দরকার, গবেষণা দরকার, ফুটেজ ব্যবহারের দক্ষতা দরকার- আমাদের মেইনস্ট্রিম নির্মাতাদের অনেকেরই তা নেই। ১৯৭২ সালে তৈরি বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ওরা ১১ জন। তার একটি দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আসল একটি ফুটেজ। কিন্তু সেই ফুটেজটিই ঘুরেফিরে এখনো ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিক নির্মাতারা কেন এমন ছবিতে অর্থ ব্যয় করেন না এমন প্রশ্নে চিত্রপরিচালক সোহানুর রহমান সোহান বলছেন, বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত না আসার শঙ্কায় বাণিজ্যিক নির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন না। যে টাকায় এখানে সিনেমা হয় তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা হয় না। যাঁরা সিনেমা বানান তাঁরা ব্যবসার জন্য তা করেন। যদি টাকা লগ্নি করে তা  ফেরত না আসে তাহলে টাকা কেন খরচ করবে।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে অর্ধশতের মতো। এর বাইরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। কিন্তু সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ কোনো গেরিলা অভিযান, সে সময়ের নানা রাজনৈতিক ঘটনা, এর আগে ও পরের রাজনীতির পটভূমি- এর কোনোটিই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এসব চলচ্চিত্রে প্রকৃতঅর্থে ফুটে ওঠেনি।  যেমনটা দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি পশ্চিমা অনেক ছবিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এখনো ইউরোপ-আমেরিকায় সাড়া জাগানো সব চলচ্চিত্র তৈরি হয়।

সর্বশেষ খবর