রবিবার, ২১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

৫০ বছরে নাটকের চাওয়া-পাওয়া

৫০ বছরে নাটকের চাওয়া-পাওয়া

স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পার করে আমরা এখন ডিজিটাল যুগে। এই ৫০ বছরে পাল্টে গেছে পুরো দেশীয় নাটকের জগৎ। বিটিভির পর আমরা এখন প্রচুর দেশীয় চ্যানেলের ঘুরপাকে আবর্তিত হচ্ছি। ফলে এই সময়ে নাটকের গল্প, নির্মাণ, ভাষা, পাশ্বলিপি, চরিত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। দর্শকদের রুচিতেও সেই প্রভাব পড়েছে। ৫০ বছরে নাটকের পালাবদলে কিছু গুণী অভিনয়শিল্পীর চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আয়োজন সাজিয়েছেন- পান্থ আফজাল

লাকী ইনাম : সেই ’৭২ থেকে বিটিভিতে কাজ করছি। তখন তো সীমিত পরিসরে-পরিবেশে কাজ করা হতো। তার পর কোয়ালিটি, নির্মাণ, শিল্পী নির্বাচন-সবই ছিল নিয়ন্ত্রিত। আস্তে আস্তে নাটক প্রচারের পরিব্যাপ্তি বাড়ল। অনেক চ্যানেল হলো। ফলে দুটি দিক দেখা গেল-পজিটিভ ও নেগেটিভ। প্রচুর নাটকে কাজ করে অনেকে গাড়ি, বাড়ি করল। অনেক টাকার মালিক হলো। অন্যদিকে নাটকের মান কমতে শুরু করল। কারণ, কোয়ান্টিটি নাটকের মান কমিয়ে দেয়। এখন তো আমাদের গল্প নেই, স্ক্রিপ্ট নেই, ভালো নির্মাণ নেই। যতই আধুনিকতা আসুক না কেন, টেক্সট ভালো না হলে কোনো কিছুই ভালো হবে না। আজ তো দেখা যায়, চরিত্র অনুযায়ী কেউ কস্টিউম পড়ে না, আজগুবি ভাষায় কথা বলে। আঞ্চলিক ভাষার নামে জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো বাদ দিতে হবে। চ্যানেলগুলোকে শক্ত হতে হবে। প্রমিত বাংলা ভাষাকে প্রমোট করতে হবে। তবে আশার কথা, সেই পুরনো মোড়ক থেকে বিটিভি এখন বের হতে পেরেছে।

আবুল হায়াত : চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে অনেক পেয়েছি, আবার অনেক হারিয়েছি। এর মধ্যে বিটিভি সময়ের সঙ্গে চলতে পেরেছে, এটা আশাব্যঞ্জক। গোল্ডেন যুগে অনেক কিছুই পেয়েছি। ভালো নির্মাতা, টেকনিশিয়ান, শিল্পী ও কলাকুশলী। তারপরও কিছু মুনাফালোভী মানুষের কারণে নাটকের  গৌরবময় দিক আমরা হারাতে বসেছি। নাটকের কোয়ালিটি কমে গেছে। ভালো কাজের পরিমাণ কমে গেছে, খারাপ কাজের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আমাদের কিন্তু সবই আছে। তবে স¦ার্থালোভী কিছু মানুষের কারণে নাটকের ইন্ডাস্ট্র্রি ডুবতে বসেছে। সিনিয়র অভিনয়শিল্পীদের প্রতি চরম অবহেলা করা হচ্ছে। আর ভাষাকে বিকৃত করে নিয়মিত নাটক নির্মিত হচ্ছে। মিক্সড ভাষা ব্যবহার করে নাটকের মান খুবই নিচে নামানো হচ্ছে ইচ্ছা করেই। আমরা তো প্রমিত ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি। সেই ভাষাকে আমরা ইচ্ছা করেই নষ্ট করে নাটক নির্মাণ করছি। মাঝে অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছিল। সেটা নিয়ে প্রতিবাদ হওয়ার ফলে কিছুটা কমেছে। আসলে নাটক ইন্ডাস্ট্রির ভালোর জন্য এসবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা এখনো নাটক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আশাবাদী।

আমিরুল হক চৌধুরী : আমরা সিনিয়র অভিনয়শিল্পীরা সঠিকভাবে সমাদৃত হচ্ছি না। যে সম্মানী পাই তা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। আমাদের মূল্যায়ন না নির্মাতা, না চ্যানেল মালিক, না প্রযোজক-কেউ সঠিকভাবে করতে পারছে। নাটকের মান কমে গেছে, ভাষা বিকৃত করে অশ্লীল মানহীন নাটক নির্মিত হচ্ছে। গল্প, স্ক্রিপ্ট ছাড়া নাটক বানাচ্ছেন নির্মাতারা। এই কি চেয়েছিলাম আমরা?

আজিজুল হাকিম : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম কিশোর। যখন কাজ শুরু করলাম, তখন তো একটাই চ্যানেল, বিটিভি। এখন তো প্রচুর চ্যানেল, প্রচুর অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও টেকনিশিয়ান। তবে আমি সবকিছুকেই পজিটিভলি দেখি। সেই সময় নাটকগুলোতে পারিবারিক গল্প ছিল। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা কাজ করেছি, অভিনয় করেছি। দেশ এখন ডিজিটাল হয়েছে। টেকনোলজি ডেভেলপ হয়েছে। ফলে রুচি ও চাহিদারও পরিবর্তন হয়েছে। তাই খারাপ কাজ যেমন হচ্ছে তেমনি ভালো কিছু কাজও হচ্ছে। দুটোকেই গ্রহণ করতে হবে। তবে একটাই কথা, সোসাইটি নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত তারা যেন ভালো কিছুর জন্য নিবেদিত থাকেন। আর দর্শকরাই কিন্তু বিচারক। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, কী গ্রহণ করবে আর কী করবে না। সবকিছু সময়ের ওপরই আমাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।

 দিলারা জামান : এখন তো তাড়াহুড়ো করে একগাদা নাটক নির্মিত হচ্ছে। অভিনয় না শিখে আসা কিছু শিল্পীকে নাটকে যুক্ত করা হচ্ছে। অশ্লীল ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির নাটক নির্মিত হচ্ছে। ভাষাকে বিকৃত করে আজগুবি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। ভালো কনটেন্ট নেই। একই রকম রোমান্টিক গল্প। কাজ করা হচ্ছে দায়সারাভাবে। ফলে ভালো নাটক দর্শক দেখতে পারছেন না। জনপ্রিয়তা ভিউ দিয়ে কাউন্ট হয়! নির্মাতারা দিনে দিনে সিনিয়র চরিত্র কাটছাঁট করছেন।

মামুনুর রশীদ : নাটকে বাবা থাকলে মা নেই আবার মা থাকলে বাবা নেই! তাই এসব নাটক দর্শকদের মধ্যে কোনো আবেগ সৃষ্টি করতে পারছে না। চরিত্র কাটছাঁট করা হচ্ছে। ভাষাকে বিকৃত করে নাটক নির্মিত হচ্ছে। এগুলো ঠিক করা দরকার।

আসাদুজ্জামান নূর : এখন তো ভালো নাট্যকারের অভাব, স্ক্রিপ্টের অভাব। এই অভাবটা একই সঙ্গে মঞ্চে এবং টিভিতে। এখন তো সবাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। নাটকে নেই কোনো অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন! নাটকে ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে বিকৃতভাবে। ফলে মানহীন নাটক নির্মিত হচ্ছে।

 চঞ্চল চৌধুরী : নাটকের মূল সমস্যা স্ক্রিপ্টিং। তাৎক্ষণিক গল্প দিয়েই নাটক নির্মিত হচ্ছে। প্রমিত ভাষাকে নাটকে ব্যবহার করা দরকার। অশ্লীল সংলাপ ও অ™ভূত অঙ্গভঙ্গি করে নাটকে অভিনয় করেন অনেকেই। এগুলো পরিহার করা উচিত। বিশেষ করে চ্যানেলগুলো মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানো দরকার।

সর্বশেষ খবর