শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

এই সময়ে যেমন আছেন রুনা লায়লা

এই সময়ে যেমন আছেন রুনা লায়লা

অনেকেই রুনা লায়লাকে খুব গম্ভীর ভাবেন। অথচ অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে থেকেও খুব সহজ, সরল আর প্রাণবন্ত তিনি। নতুন কিংবা পুরনো কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঠোঁটের কোণে সহজ-সরল হাসি লেগেই থাকে। রুনা লায়লা এমনই। তাঁর চারপাশের মানুষগুলো যেন তাঁর মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে থাকেন। করোনার এই সময়ে কীভাবে কাটছে গুণী এই শিল্পীর সময়, তা-ই তুলে ধরেছেন- আলী আফতাব

 

করোনায় যেমন কাটছে রুনা লায়লার সময়

করোনার প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হননি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। করোনা টিকা নেওয়ার জন্য এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পরপর দুই দিন স্টেজ শোতে সংগীত পরিবেশন করার জন্য তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। তাছাড়া আর বাসা থেকে রুনা লায়লা বের হচ্ছেন না করোনার কারণে। তাহলে কীভাবে সময় কাটছে ঘরে বসে রুনা লায়লার এমন প্রশ্ন করতেই রুনা লায়লা বলেন, ‘সত্যি বলতে যে রকম প্রায় সবারই ঘরে বসে সময় কাটে ঠিক তেমনি আমার সময়ও কাটছে। তবে হ্যাঁ একেকজনের জীবনধারা একেক রকম। আমি যেমন নিয়মিত বই পড়ি, গান শুনি। আবার এর পাশাপাশি কিছু নতুন নতুন সুরও সৃষ্টি করছি। কারণ এখন তো নতুন করে আমি গান সুর করছি বিধায় বলা যায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সুর ভাবনায় আসছে।’ সাধারণত কার গান আপনি শুনে থাকেন? ‘আমি আসলে সবার গানই শুনি। নির্দিষ্ট করে কারও নাম বলা যাবে না। আবার অনেকের গান থেকে আমি নিজেও কিছু শেখার চেষ্টা করি। দেশের মধ্যে যাদের গান বেশি ভালো লাগে তাদের কিন্তু আমি নিজে থেকেই ফোন করে বা মেসেজ দিয়ে অনুপ্রেরণাও দিয়ে থাকি’ বললেন রুনা লায়লা। আপনি নিজের গান শোনেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রুনা লায়লা বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই নিজের গানও শুনি। নতুন পুরনো সব গানই শোনা হয়ে থাকে আমার। সেসব গানে নিজেরই ভুল-ত্রুটিগুলো বের করার চেষ্টা করি। এমন গানও পাই যে নিজেরই আফসোস হয় আরেকটু ভালো হলে আরও ভালো হতে পারত।’

প্রশ্ন রাখি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রথম কী করবেন? জবাবে রুনা লায়লা বলেন, ‘জানি না কবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে ইচ্ছা আছে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ইনশাআল্লাহ শুরুতেই লন্ডনে যাব আমার মেয়ে তানির কাছে। সেই যে গত বছর মার্চ মাসের শুরুতে এসে বাসায় বন্দী হয়েছি এরপর তো আর তেমন বাসা থেকে বের হইনি। তাই লন্ডনে যাওয়ার জন্যই মনটা অস্থির হয়ে আছে। নাতি দুজনকেও দেখতে খুব ইচ্ছা করছে, আদর করতে ইচ্ছা করছে। যদিও প্রতিনিয়ত হোয়াটসঅ্যাপে দেখছি কিন্তু তারপরও সামনাসামনি বসে দেখা, কথা বলার ভালো লাগাটুকু, আনন্দটুকুই অন্যরকম। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাদের ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন। সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল আপনারা সবাই সচেতন থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন আর অবশ্যই জরুরি কাজে বাইরে বের হলে ভালোভাবে মাস্কটা পরে নেবেন।’

রুনা লায়লা জানান, গেল ২৩ মার্চ ন্যাশনাল প্যারেড গ্রাউন্ডে এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন।

মোহাম্মদ রফি ও কিশোরের সঙ্গে কিছু স্মৃতি

মোহাম্মদ রফি ও কিশোর কুমারের সঙ্গে অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে রুনা লায়লার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মোহাম্মদ রফি ও কিশোর কুমারের সঙ্গে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে গেছি আমি। কিশোরদা খুব মজা করতেন। চমকে দিতে ভালোবাসতেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় একসঙ্গে কোনো গান রেকর্ড হয়নি। সেবার কলকাতার নেতাজি স্টেডিয়ামে শো। আমি, কিশোরদা এবং মোহাম্মদ রফি।

আমি ব্যাক স্টেজে ঢুকে ড্রেসিংরুমে। ওখানে যারা ছিল তাদের জিজ্ঞেস করলাম মোহাম্মদ রফি ও কিশোরদা এসেছেন কিনা? কিশোরদা পেছনের দরজায় লুকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ লাফ দিয়ে সামনে এসে বললেন, নমস্কার, আমি এখানে। আমি চমকে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে আবার বললেন, দেখ আমি তোমাকে কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম। আমি যখন স্টেজে গাইছি তখন অডিয়েন্সের মধ্যে গিয়ে নানান ফানি চেহারা করতেন। মজার এক মানুষ ছিলেন।

আমেরিকায় প্রথম গানের অনুষ্ঠান

গানকে সঙ্গে নিয়ে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন এ গুণী শিল্পী। অনেক দেশে রয়েছে অনেক ধরনের মজার অভিজ্ঞতা। তেমনি এক অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। ১৯৭৭-এ আমি প্রথমবারের মতো আমেরিকা যাই বাংলাদেশ আমেরিকান কালচারাল ফোরামের উদ্যোগে। অতিথিদের বেশির ভাগ ডিপ্লোম্যাট, সিনেটরস।

আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আসবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি আর আসতে পারলেন না। এলেন তার পুত্র চিফ কার্টার এবং পুত্রবধূ। সবার শেষে আমি দামাদাম মাস্তকালান্দার গানটি গাইলাম। পুরো হল তখন নাচছে, তালি বাজাচ্ছে। চিফ কার্টার এবং এফবিআইর সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল যে, হঠাৎ কী হলো? চিফ কার্টার আমাদের হাইকমিশনারকে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে? তিনি চিফ কার্টারকে আশ্বস্ত করলেন চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। বোঝালেন আমার এ গানটা সবার খুব প্রিয় এবং গানটা গাইলে সবাই খুব এক্সাইটেড হয়ে যায়।

 

কাশ্মীরে বিনা পারিশ্রমিকে গান

১৯৭৮ সালের কথা। আমার কাছে একটা আমন্ত্রণপত্র এলো। তাও আবার কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহর নিজ হাতে লেখা। তিনি কাশ্মীরে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করতে চান। এজন্য আমি তাকে ফান্ড জোগাড় করে দিতে কোনো সাহায্য করতে পারব কিনা? আমি পারফর্ম করলে ফান্ড উঠবে। ভারতে তিনি অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছেন কিন্তু তাদের কেউই টাকা ছাড়া পারফর্ম করতে রাজি হলেন না। আমি তাকে উত্তর পাঠালাম। আমাকে হাতে লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এজন্য আমি সম্মানিত বোধ করছি। যেহেতু আপনি একটি মহৎ উদ্দেশ্যে ফান্ড তুলতে চাইছেন সেখানে পারিশ্রমিক নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু বললাম আমার সঙ্গে কয়েকজন মিউজিশিয়ান আসবেন এবং আমার পরিবারের কয়েকজন সদস্য যেতে ইচ্ছুক। তিনি আমাকে সাদরে কাশ্মীর আমন্ত্রণ জানালেন।

লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে তার অফিশিয়াল রেসিডেন্সে থাকতে দিলেন। বাড়িতে দাওয়াত করলেন। অনুষ্ঠানের দিন তিনি এমন এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন যা কোনো দিন ভুলবার নয়।

আমি বাংলাদেশের একজন শিল্পী যিনি মানবতার ডাকে এসেছি। বিনা পারিশ্রমিকে গান গাইছি- সব বললেন। শুধু আমাকে নয় বাংলাদেশের মানুষকে, বাংলাদেশ সরকারকে তিনি ধন্যবাদ জানান।

এত স্বনামধন্য একজন রাজনীতিবিদের কাছ থেকে এতটা সম্মান পেয়ে সেদিন শিল্পী হিসেবে, বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে আরেকবার গর্ববোধ করলাম।

সর্বশেষ খবর