সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বিদায় বাহাদুর নায়ক ওয়াসিম

বিদায় বাহাদুর নায়ক ওয়াসিম

জন্ম : ২৩ মার্চ, ১৯৫০-মৃত্যু : ১৮ এপ্রিল, ২০২১

ওয়াসিম, সত্তর থেকে নব্বই দশকের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। তিনি ছিলেন বডি বিল্ডার। সুদর্শন এই মানুষটিকে এক নজর দেখেই মনে ধরে যায় চিত্রনির্মাতা এস এম শফীর। তিনি ওয়াসিমকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। কিছু দিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন। শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।  এই প্রয়াত অভিনেতাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

অভিমান নিয়েই চলে গেলেন

অভিমান নিয়ে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম। জীবদ্দশায় ওয়াসিম জানিয়েছিলেন চলচ্চিত্র জীবনে তাঁর কোনো অপ্রাপ্তি নেই। অর্থ, যশ, খ্যাতি সবই পেয়েছেন তিনি। তবে তাঁর একটি ক্ষোভ আছে। সেটি হলো ১৯৭৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার নাম বাদ দিয়ে অন্য সবার নাম ঘোষণা করে পুরস্কার দেওয়া হয়। ওয়াসিমের কথায়-‘ঈমান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়।

 

যেভাবে বডি বিল্ডার থেকে সুপারস্টার

মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ নামের মানুষটি বাংলা চলচ্চিত্রে এসে হয়ে যান ওয়াসিম। কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি বডি বিল্ডার হিসেবে নাম করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডিংয়ের জন্য মি. ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করেছিলেন। ওয়াসিম ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালের ২৩ মার্চ চাঁদপুর জেলার আমিরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭২ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এস এম শফীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। শফী এই সুদর্শন মানুষটিকে দেখে অভিনয়ে আনতে চাইলেও ওয়াসিমের তেমন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু শফীর আগ্রহেই ১৯৭২ সালে তাঁর পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হন তিনি। এতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। ১৯৭৪ সালে আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মোহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তাঁর। চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান তিনি। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়াসিম অভিনীত ও এস এম শফী পরিচালিত ‘দি রেইন’ তাঁকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। পৃথিবীর ৪৬টি দেশে ‘দি রেইন’ মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি বাম্পার হিট হয়। আর ওয়াসিমকে অভিনেতা হিসেবে পৌঁছে দেয় অনন্য উচ্চতায়। ১৯৭৩ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকার চলচ্চিত্রে ওয়াসিম ছিলেন শীর্ষ নায়কদের একজন। সাহসী নায়ক বলা হতো তাঁকে। আবার কেউবা বলতেন ওয়াসিম মানে বাহাদুর নায়ক। ওয়াসিম ফোক ফ্যান্টাসি আর অ্যাকশন ধারার ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী ড্যাশিং হিরো। পর্দায় ওয়াসিম যখন ঘোড়া চালিয়ে আসতেন তখন ছবিঘর করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠত। তাঁর নাম দিয়েই ছিল তখন উল্লাস। ওয়াসিম প্রায় ১৫২ ছবির নায়ক ছিলেন।

যে কারণে চলচ্চিত্র ছাড়েন

ওয়াসিম বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী রোজীর ছোট বোনকে। তাদের দুটি সন্তান। পুত্র দেওয়ান ফারদিন এবং কন্যা বুশরা আহমেদ। ২০০০ সালে তার স্ত্রীর অকাল মৃত্যু ঘটে। ২০০৬ সালে ওয়াসিমের কন্যা বুশরা আহমেদ ১৪ বছর বয়সে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। পরীক্ষা চলাকালীন নকলের অভিযোগ তার পরিবারকে জানানোর প্রাক্কালে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে বুশরা লাফ দেয়। পুত্র ফারদিন লন্ডনের কারডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে এখন ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত। মূলত স্ত্রী আর কন্যার অকাল মৃত্যু ওয়াসিমের জীবনে বিষাদ নেমে আসে। সব কিছু থেকে দূরে সরে যান তিনি। বেছে নেন একাকী জীবন।

 

অভিনয় ছাড়ার পর

ওয়াসিম অভিনয় ছেড়েছিলেন ২০১০ সালে। এরপর থেকে তিনি এফডিসিতে খুব একটা যেতেন না, যোগ দিতেন না কোনো টিভি প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানে। লোকচক্ষুর অন্তরালেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক সময়ের সুপারহিট এ নায়ক। ২০০৭ সালে তিনি সর্বশেষ ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান মো. আওয়াল পরিচালিত ‘আমার রতœগর্ভা মা’ এবং ২০০৯ সালে জীবন রহমান পরিচালিত ‘কাঁকন দাসী’ ছবিতে। এ দুটি ছবির নির্মাণকাজ আর শেষ হয়নি। ২০১০ সালের পর চিত্রজগৎ থেকে নিজেকে একেবারেই গুটিয়ে ফেলেন ওয়াসিম, চেনাজানা লোকজনের কাছেও ঘেঁষতে চাইতেন না। ফোন কলও রিসিভ করতেন না। বিষাদগ্রস্ত ওয়াসিম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একা থাকতেই বেশি ভালোবাসতেন। বই পড়তেন, ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ২০১০ সালের দিকে একবার এফডিসিতে এলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। তখন কথা বলতে গিয়ে বারবার আবেগে তাঁর কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র আমাকে অনেক দিয়েছে। চলচ্চিত্রকেও আমার আরও অনেক কিছুই দেওয়ার ছিল। কিন্তু সেই সময় বোধহয় এখন আমার আর নেই...! তার শান্ত-সৌম্য চেহারাকে ফাঁকি দিয়ে চোখের কোণে তখন স্মৃতির জল চিকচিক করছিল।

 

তিন নায়িকার সফল নায়ক

শতাধিক ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে কিংবদন্তি অভিনেতার সারিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন অভিনেতা ওয়াসিম। অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে ছবিকে সফল করেছিলেন তিনি। তবে তাঁর অভিনয় জীবনে তিন নায়িকার সঙ্গে কাজ করা ছবি সবচেয়ে বেশি সফলতা পায়। এই তিন নায়িকা হলেন-অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ ও শাবানা। বিখ্যাত ‘দি রেইন’ ছবিতে ওয়াসিমের নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া। পরবর্তী সময়ে ওয়াসিম-অলিভিয়া জুটি বেঁধে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন। ‘বাহাদুর’ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন প্রভৃতিও সফল হয়েছিল।

‘রাজ দুলারী’তে ওয়াসিম ও শাবানার অভিনয় দর্শকদের দারুণভাবে মুগ্ধ করেছিল। ছবিতে তাদের মুখের গানগুলো ছিল দর্শকের মুখে মুখে। অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে রয়েছে ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘আবেহায়াত’, ‘চন্দনদ্বীপের রাজকন্যা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘রসের বাইদানী’সহ বেশ কটি সুপারহিট ছবি।

 

 

চলচ্চিত্র প্রযোজক

ওয়াসিম চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ডব্লিউ আর প্রোডাকশন। তাঁর প্রযোজিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে হিসাব চাই, মোহন বাঁশি, নয়া তুফান, সীমাবদ্ধ ইত্যাদি। প্রযোজক হিসেবে ওয়াসিম খুব সফল হতে পারেননি।

 

উল্লেখযোগ্য ছবি

দর্শকনন্দিত এই অভিনেতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি হলো- দি রেইন, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, দোস্ত দুশমন, মানসী, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, রাতের পর দিন, আসামি হাজির, মিস লোলিতা, রাজ দুলারী, চন্দনদ্বীপের রাজকন্যা, লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন, ঈমান, জীবন সাথী, রাজনন্দিনী, রাজমহল, বিনি সুতার মালা, বানজারান, মিস লোলিতাসহ প্রায় ১৫২টি সুপারহিট ছবির নায়ক ছিলেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা।

সর্বশেষ খবর