বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

শর্তে আটকে আছে যৌথ প্রযোজনা

আলাউদ্দীন মাজিদ

শর্তে আটকে আছে যৌথ প্রযোজনা

‘বিগত কয়েক বছর ধরে চিৎকার আর আবেদন করে যাচ্ছি, শুধু যৌথ নীতিমালার নতুন শর্ত বাতিল বা শিথিল নয়, চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না। আশ্বাসে বিশ্বাস করে চলতে গিয়ে স্বপ্ন পূরণ তো হচ্ছেই না উপরন্তু চলচ্চিত্রশিল্প দিনের পর দিন ধ্বংসই হয়ে যাচ্ছে।’ এমন আক্ষেপ একজন চলচ্চিত্র প্রযোজকের। চলচ্চিত্র নির্মাণে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার একটি মাত্র শর্তের কারণে আটকে গেছে যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ। অশ্লীলতা, নকল ও পাইরেসির কারণে নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে যখন চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নামে তখনই ২০১৪ সালে যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সিনেমা হলে দর্শক ফিরিয়ে আনে। ছবিটি কলকাতার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়। এরপর যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণে নির্মাতারা আগ্রহী হয়ে ওঠেন ও সিনেমা শিল্পে প্রাণ ফিরে আসে। নির্মাণ হতে থাকে ‘শিকারি’, ‘বাদশা’, ‘নবাব’, ‘চালবাজ’, ‘ভাইজান এলোরে’, ‘ব্ল্যাক’, ‘রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট’সহ অনেক ছবি। এসব ছবি দেখতে সিনেমা হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় হয়েছিল। কিন্তু সরকার যখন ২০১৭ সালে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সংশোধন করে এতে নতুন একটি শর্ত যুক্ত করে দেয়, তখনই বাধে বিপত্তি। এই শর্তের ঙ এর ০২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সাধারণভাবে যৌথ চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পী এবং মুখ্য কারিগরি কর্মীসহ শিল্পী ও কলাকুশলী, লোকেশন সমানুপাতিক হারে নিয়োগের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রযোজক সমিতির কর্মকর্তা কামাল কিবরিয়া লিপু বলছেন, এই শর্ত অনুযায়ী কাজ করা এখনো সম্ভব নয়। কারণ আমাদের দেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি নির্মাণ শুরু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। তাই আমাদের কলাকুশলীরা ‘ডিজিটালাইজের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল দিকের কাজে এখনো শতভাগ দক্ষতা অর্জন করে ওঠতে পারেনি। এ অবস্থায় নতুন শর্ত অনুযায়ী যখন ভারত বা অন্য দেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় কাজ করতে যাই তখন আমাদের কলাকুশলীরা অদক্ষ বলে তাঁদের মেনে নেয় না। আমার কথা হলো আগে আমাদের কলাকুশলীদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার সময় দিতে হবে। তারপর নতুন শর্তে কাজ করতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কামাল কিবরিয়া লিপু বলেন, সরকার ও চলচ্চিত্রের সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে বলব, দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের স্বার্থে আবার যাতে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ বজায় রাখা যায় সে জন্য সবাইকে উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা বা কোটা রাখা যাবে না। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র শিল্পের যে অচলাবস্থা চলছে তাতে করে বিগ বাজেট ও অ্যারেঞ্জম্যান্টের ছবি আমাদের একার পক্ষে নির্মাণ সম্ভব নয়। আর মানসম্মত ছবি না পেলে কখনই সিনেমা হলে দর্শক ফেরানো যাবে না। যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ হলে উন্নত বাজেট ও অ্যারেঞ্জমেন্টের কারণে তা সহজেই দর্শকনজর কাড়তে পারবে। প্রযোজক সমিতির আরেক কর্মকর্তা ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলীমউল্লাহ খোকন উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর কোথাও যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় এমন ধরাবাধা নিয়ম নেই। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার কথাই যদি বলি তাহলে বলতে হয় তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে মানে দুই দেশের নির্মাতারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিল্পী-কলাকুশলী নির্ধারণ করে নেন। ওইসব দেশের সরকারের ক্ষেত্রে এসব মূল বিষয় নয়, তাদের কাছে বিনিয়োগটাই মুখ্য। অথচ আমাদের দেশে ২০১২ সালের নীতিমালায়ও অন্য দেশের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আমরা ভালোভাবে কাজ করে আসছিলাম। ২০১৭ সালের নীতিমালায় এমন বাধ্যতামূলক শর্ত আরোপের ফলে জাজ মাল্টিমিডিয়া কলকাতার সঙ্গে এই নীতিমালা প্রণয়নের আগে কাজ শুরু করা ‘নূরজাহান’, ‘বেপরোয়া’, ‘ককপিট’ ছবি তিনটি মুক্তি দিতে বাধার মুখে পড়ে এবং পরে এগুলো ভারতীয় ছবি হিসেবে আমদানি করতে বাধ্য হয়। এই ক্ষতিকর শর্ত বাতিল না হলে সরকার চলচ্চিত্রের উন্নয়নে যতই অনুদান আর প্রণোদনা দিক না কেন তাতে কোনো সুফল আসবে না। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে যৌথ প্রযোজনার এই নতুন নীতিমালা প্রণয়নের পর একটিমাত্র শর্তের কারণে আটকে গেছে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ। ২০১৮ সালে ‘বালিঘর, ‘প্রেম আমার টু’ ও ‘সুলতান : দ্য সেভিয়ার’ নামে যৌথ প্রযোজনার তিনটি ছবির চিত্রনাট্য অনুমোদন পায়। পরে ‘প্রেম আমার টু’ ও ‘সুলতান : দ্য সেভিয়ার’ ছবি দুটি নতুন নীতিমালায় নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতার একক ছবি হিসেবে তৈরি হয়। আর ‘বালিঘর’-এর কাজ বাতিল হয়। ছবিটির পরিচালক অরিন্দম শীল সে সময় জানিয়েছিলেন, নতুন নীতিমালার জটিল প্রক্রিয়ার কারণে ‘বালিঘর’ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। প্রযোজকদের অনেকে মনে করেন, শুটিং চলাকালে গল্পের প্রয়োজনে লোকেশন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হতে পারে। ফলে এরকম কঠোর নিয়ম মেনে সৃজনশীল কাজ করা প্রায় অসম্ভব। ‘প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘আমরা এক মিটিংয়ে তথ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি নতুন করে বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তিনি কথা দিয়েছিলেন একটি কমিটি গঠন করে যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কিছুই হয়নি।’ খসরু জানান, সংশোধিত এই নীতিমালা মেনে দুই দেশের কোনো প্রযোজকই কাজ করতে আগ্রহী নন। যাঁরা একসময় নীতিমালায় পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তাঁরাই এখন বলছেন, সংশোধনের পর নীতিমালা কঠিন হয়ে গেছে। অথচ কয়েক বছর আগে যৌথ প্রযোজনার ছবির কারণে বেশ চাঙা হয়ে উঠেছিল চলচ্চিত্রাঙ্গন। নীতিমালা নমনীয় হলে আবারও যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ বাড়বে। ফিরে আসবে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রাণ।

সর্বশেষ খবর