সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভালো নেই ক্যামেরার পেছনের কারিগররা

ভালো নেই ক্যামেরার পেছনের কারিগররা

একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে নির্মাতা ও তারকাদের পাশাপাশি কলাকুশলীদের ভূমিকাও মুখ্য। তাঁদের ঘাম ঝরা পরিশ্রমে নির্মিত হয় একটি পরিপূর্ণ ছবি। চলচ্চিত্র জগতে দীর্ঘদিন ধরে সুবাতাসের অভাব। এমন দুঃসময় কীভাবে পার করছেন তাঁরা।  সে কথা তুলে ধরেছেন আলাউদ্দীন মাজিদ

 

আবু মুসা দেবু

[চলচ্চিত্র সম্পাদক, নির্মাতা]

চিত্রসম্পাদক আবু মুসা দেবু। গুণী এই মানুষটি কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বসহ অন্য চিত্রসম্পাদকরাও এখন আয়-রোজগার নিয়ে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত। ১৯৬০ সালে ‘সূর্যস্নান’ চলচ্চিত্র সম্পাদনার মাধ্যমে বড় পর্দায় পা রাখেন। চিত্রসম্পাদক হিসেবে সূর্যকন্যা, অপবাদ, যাহা বলিব সত্য বলিব, ধীরে বহে মেঘনা, ধন্যি মেয়ে, চাষীর মেয়ে, কে তুমি তার উল্লেখযোগ্য কাজ। পাশাপাশি তিনি অভিযোগ, রানী আমার নাম, মায়ের জেহাদ, আদর্শবান সিনেমাগুলো নির্মাণ করেন।

 

ইমদাদুল হক খোকন

[নৃত্য পরিচালক]

‘বর্তমানে হাতে ছবির কাজ নেই বললেই চলে। এ দুরবস্থা কমপক্ষে আটবছর ধরে চলছে। টুকটাক মিউজিক ভিডিও ও বিজ্ঞাপনের কাজ করেই কোনোভাবে সময় কাটছে এখন। চলচ্চিত্রের আয় আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ছেলে আর সহধর্মিণীকে নিয়ে বসবাস করছি মিরপুরের পৈতৃক বাড়িতে। বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়েই এখন কোনোভাবে সংসার চলছে বলা যায়।’ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে দুঃখভরা কথাগুলো বললেন প্রখ্যাত নৃত্য পরিচালক ইমদাদুল হক খোকন। ১৯৮৪ সালে চিত্রপরিচালক এফ কবির চৌধুরীর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। এই নৃত্যকুশলী তখন বুলবুল একাডেমির নাচের শিক্ষক। এক দিন এফ কবির চৌধুরী একজনকে নাচ শেখাতে নিয়ে যান বুলবুল একাডেমিতে। সেখানেই খোকনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এই নির্মাতা তাঁকে চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনার প্রস্তাব দিলে ১৯৮৪ সালে এ নির্মাতার ‘বুলেট’ ছবি দিয়ে খোকনের চলচ্চিত্র জীবন শুরু। সেই সময় দক্ষ কাজের সুবাধে চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার নজরে পড়েন খোকন। সোহেল রানা তাঁর প্রযোজিত ‘লড়াকু’ ছবির জন্য প্রস্তাব দেন তাঁকে। ছবিটি পরিচালনা করেন শহীদুল ইসলাম খোকন। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া  এই সুপারহিট ছবিটিই বড় পর্দায় আসা খোকনের প্রথম ছবি। তারপর এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২শ ছবিতে কাজ করেন তিনি। ২০১০ সালে ‘মোঘলে আজম’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা নৃত্য পরিচালকের সম্মান পান। এ ছাড়া নানা সংগঠনের অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। খোকনের কথায় একসময় একই দিন ৩-৪টি ছবির নৃত্যপরিচালনা করতে হতো। শিডিউল দিতে পারতাম না। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে এ অবস্থার অবনতি হতে থাকে। দুঃখ বোধ হচ্ছে আমিসহ সিনিয়রদের কাজের মূল্যায়ন এখানে হয় না।

 

আতিকুর রহমান চুন্নু

[ফাইট ডিরেক্টর]

আতিকুর রহমান চুন্নু। নন্দিত অ্যাকশন পরিচালক। রুপালি জগতে চুন্নুর পদার্পণ ১৯৭৭ সালে চিত্রপরিচালক মোতাহার হোসেনের হাত ধরে। এরপর চিত্রনায়ক জসিমের সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। জায়গা পান জসিমের ফাইটিং দল ‘জেমস গ্রুপ’-এ। তাঁর হাত ধরেই চুন্নু বনে যান অ্যাকশন পরিচালক। তিনি এখন পর্যন্ত ৭০০ সিনেমায় কাজ করেছেন। কলকাতার ‘শিবা’, ‘অন্যদাতা’, ‘অন্যায়’সহ বেশ কিছু ছবিতেও কাজ করেছেন চুন্নু। কিছুদিন রাজউকেও চাকরি করেছেন। তাঁর কথায়, ‘এক দশক ধরে ছবির কাজ কমার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মতো আমার হাতেও তেমন কাজ নেই। ভিন্ন পেশায় গিয়ে কোনোভাবে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করছি।’ ইন্ডাস্ট্রির মানুষের কাছে তিনি চুন্নু মামা বলেই পরিচিত।

 

সেলিম মোহাম্মদ

[মেকআপ আর্টিস্ট]

চলচ্চিত্রে ১৯৮২ সাল থেকে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন সেলিম মোহাম্মদ। দীর্ঘ ৩৮ বছরের কর্মজীবনে নায়করাজ রাজ্জাক, রাজীব, আলমগীর, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাকিব খান, দিতি, ববিতা, শাবানা, রোজিনা, মৌসুমী, শাবনূর, অপু বিশ্বাসসহ সব ক্যাটাগরির শিল্পীর মেকআপের কাজ করেছেন। এক দশক ধরে ছবির কাজ উদ্বেগজনক হারে কমে যাওয়ায় সেলিমের আর্থিক অবস্থাও সংকটে। চলচ্চিত্রে কাজ কমে যাওয়ায় জীবন ধারণ করতে টিভি নাটকের কাজও করেন সেলিম। তিনি বলেন, একসময় প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫ দিন শুটিং থাকত। তারপর চলচ্চিত্রের মন্দাবস্থা শুরু হলে জমানো টাকা ভেঙে চলতে হয়েছে। অন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই যে, সেখান থেকে কিছু ইনকাম আসবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হচ্ছে কাজ না থাকার পরও প্রতি মাসে ঘর ভাড়া দিতে হয়েছে। জমানো টাকাও প্রায় শেষ। সংসারে টানাটানির সময় আসছে। তাই উপায় না পেয়ে টিভি নাটকের কাজে নেমে পড়েছি। এখন আমাদের বেকারত্ব বাড়ছে। ভবিষ্যতে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখছি না। ফিল্ম মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সেলিম মোহাম্মদ বলেন, চলচ্চিত্রের সব মেকআপ আর্টিস্ট সামর্থ্যবান নয়। অনেকেই কাজ না থাকায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। কেউবা আবার ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশায়ও নেমেছেন। আমাদের বেকারত্ব বেড়েই যাচ্ছে।

 

সবুজ খান

[মেকআপ আর্টিস্ট]

চলচ্চিত্রের সুপরিচিত মেকআপ আর্টিস্ট সবুজ খান। তিনি জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের ব্যক্তিগত মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন। সবুজ জানান,  কাজ কমে যাওয়ায় কেউ ভালো নেই। কাজ নেই, জমানো টাকা খরচ করতে হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের পরই লকডাউনের সময় এই মেকআপ আর্টিস্ট ফিরে যান গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বেকারত্ব ঘুচাতে ওয়াইফাই ব্যবসা ও মুরগির খামার দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ জন্য আগেই শাকিব ভাইয়া আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্যাকআপের জন্য বিকল্প কিছু করতে। তাঁর পরামর্শে গ্রামে গিয়ে ব্যবসাগুলো চালু করে এসেছি। চলচ্চিত্রে প্রায় ১২০ জনের মতো মেকআপ আর্টিস্ট রয়েছেন।  সবুজ খান তাঁদের মধ্যে ব্যস্ত মেকআপ আর্টিস্ট। তিনি জানালেন, তাঁর প্রায় ১৯ বছরের কর্মজীবনে চলচ্চিত্রের মন্দ সময়ের  পাশাপাশি করোনাকালই সবচেয়ে খারাপ। এত সংকট কখনো অনুভব করেননি।

সর্বশেষ খবর