শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বগুড়া ঐতিহ্যবাহী সার্কাস শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়া ঐতিহ্যবাহী সার্কাস শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে

চোখের সামনে বানর তিন চাকার সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। সাইকেল চালিয়ে যখন বানর ক্লান্ত সে সময় মস্ত বড় একটা হাতি ফুটবল খেলে চলেছে। হাতির পায়ে ফুটবল। ফুটবল খেলছে আর নাচ দেখাচ্ছে। এর মাঝেই একটি ভালুক এলো। মাইকে বলা হচ্ছে এখন এই ভালুক তেড়ে আসবে না। ভালোবাসবে আপনাকে। দুধভাত খাওয়া ভালুক। গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে! দর্শকদের করতালিতে ভালুকটার সঙ্গে আরও একটি শিশু এক চাকার সাইকেল চালিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। ভাবা যায় ভালুকের সঙ্গে শিশু খেলা করে! এমনি তারা বন্যপ্রাণীর সঙ্গে খেলে, খায় আর ঘুমায়। সার্কাসের ভিতর যারা থাকেন তারা ওভাবেই অভ্যস্ত হয়ে জীবন ধারণ করে থাকেন। কিন্তু, করোনাভাইরাস সার্কাসের জীবনটাকে থেমে দিয়েছে। চলছে না তাদের এক চাকার সাইকেল। বানর, হাতি, ভালুকের সঙ্গে সার্কাসের অন্য খেলোয়াড়গুলো শুধু বসে বসে খাচ্ছে। আর দেনা বাড়ছে। প্রায় দেড় বছর ধরে কোনো শো ছাড়াই এখনো বেঁচে আছে সার্কাসের মানুষগুলো। শো করার অনুমতি না থাকায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সার্কাস শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে।

জানা যায়, বগুড়ায় একসময় সার্কাসের বেশ কয়েকটি দল ছিল। কালক্রমে সার্কাসের প্রচলন কমে যাওয়া ও নতুন প্রজন্মের সার্কাসের প্রতি ততটা আগ্রহ না থাকায় সার্কাস দলের এমনিতেই ভালো দিন যাচ্ছে না। পৈতৃক হিসেবে পাওয়া সার্কাস দলটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বগুড়ায় যে কটি সার্কাস দল রয়েছে তার মধ্যে দ্য বুলবুল সার্কাস ও দ্য রাজমণি সার্কাস অন্যতম। এখনো টিকে আছে সার্কাস দল দুটি। বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার বাসিন্দা আলহাজ আবদুস সাত্তার স্বাধীনতার আগে দ্য বুলবুল সার্কাস গড়ে তোলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাদু বা ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে তিনি সার্কাসের দল গড়ে তোলেন। ১৯৭৫ সালে এই দলটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়। সে সময় থেকে তার দলে ১১০ জন খেলোয়াড় বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে রোজগার করে থাকতেন। দেশের সব জেলায়ই তিনি শো করেছেন। বেশির ভাগ জেলায় মাসব্যাপী শো করেছেন। এমন দিন গেছে বছরে তিন দিন বাড়ি থেকেছেন। আর ৩৬২ দিন তিনি সার্কাস প্যান্ডেলের মধ্যেই কেটে দিয়েছেন।

আবদুস সাত্তারের বয়স এখন ৯০ বছর। স্মৃতি থেকে যতটা মনে পড়ে তিনি জানিয়েছেন, সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে জাহেদা বেগম নামের এক নারী বগুড়ায় এসে সার্কাস খেলা দেখেন। খেলা দেখার পর সাত্তারের সঙ্গে জাহেদা বেগমের পরিচয় ও পরিচয় সূত্রে বিয়ে। বিয়ের পর জাহেদা বেগম দ্য বুলবুল সার্কাসের প্রধান ম্যাজিশিয়ান হয়ে গেলেন। ম্যাজিশিয়ান ছাড়াও তিনি রপ্ত করেন এক চাকার সাইকেল চালানো। বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে সুনাম কুড়ান। সাত্তার ও জাহেদার ঘরে পাঁচ সন্তানের জন্ম। প্রথম সন্তান বুলবুল আহম্মেদ, দ্বিতীয় শাহিনুর রহমান, তৃতীয় সুলতান রহমান, চতুর্থ সাকিল আহম্মেদ, পঞ্চম মেয়ে সাহেলা বেগম। সন্তানদের মধ্যে মা-বাবার হাতেখড়ি বুলবুল আহম্মেদ এখনো পুরো সার্কাসের খেলোয়াড়। শাহিনুর রহমান এখন বাংলাদেশ সার্কাস মালিক সমিতির  সাধারণ সম্পাদক। সুলতান ভাইদের সঙ্গে থেকে সার্কাসের দল চালান। আর সাকিল আহম্মেদ লেখাপড়া করেন। এরমধ্যে শাহিনুর রহমান ২০১১ সালে দ্য রাজমণি সার্কাস দল নামে নতুন করে একটি দল গড়েন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত দলটি এখন বগুড়ার নামকরা সার্কাস দল। তার দলে একটি হাতি, একটি বানর, একটি ভালুক রয়েছে। খেলোয়াড় রয়েছেন ১১০ জন। করোনাভাইরাসের আগে দলটি প্রতি মাসে কোনো না কোনো এলাকায় শো করত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দলটি থেমে গেছে। দেড় বছর ধরে পড়ে আছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার সম্পদ। ১১০ জনের মধ্যে অভাবের কারণে বেশির ভাগ চলে গেছেন ভিন্ন পেশায়। কেউ কেউ কোনো কিছু করতে না পেরে রাস্তায় রাস্তায় খেলা দেখিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। আবার কেউ কেউ কর্মই খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রায় সাত শতক জায়গার ওপর পড়ে আছে সার্কাসের প্যান্ডেল করার টিন, বাঁশ, লোহার খাঁচা, নিরাপত্তা বেষ্টনী, কাপড়, চেয়ার, টেবিল, সাউন্ড সিস্টেম, প্যান্ডেলে দর্শকদের বসার চেয়ার, দামি কাঠের তৈরি বিভিন্ন খেলার আইটেম, তার, এক চাকা, দুই চাকা, তিন চাকার সাইকেলসহ সার্কাসের খেলার বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ সার্কাস দলের অর্ধ কোটি টাকার এই মূল্যবান জিনিসপত্র এখন নষ্ট হতে চলেছে।

দ্য রাজমণি সার্কাস দলের মালিক শাহিনুর রহমান জানান, গত দেড় বছরে দেড় টাকা আয় হয়নি। অথচ বিগত দিনে শো করে যা আয় জমিয়ে রেখেছিলেন। তা খেয়ে এখন শেষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দয়া করে যদি সার্কাস মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ অনুদান দিতেন তাহলে এই শিল্পের মানুষ এক বেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেন। করোনায় সার্কাস শো বন্ধ থাকায় খরচ কমছে না। খেলোয়াড়দের যেমন পালতে হচ্ছে তেমনি বসে বসে হাতিও পালতে হচ্ছে। তাদের তিন বেলা খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক সময় ধারও করতে হচ্ছে। সার্কাস করার অনুমোদন প্রদান করলে শিল্পটিও বেঁচে যায়। তিনি জানান, বাংলাদেশ সার্কাস মালিক সমিতির আওতায় বড় বড় ২৬টি সার্কাস দল আছে। যাদের প্রতিটি দলের সঙ্গে সরাসরি গড়ে ২০০ জন জড়িত। এই ২০০ জনের সঙ্গে তাদের পরিবার যোগ করা হলে বড়সড় একটি পরিবার দাঁড়ায়। দেশের অতীত ঐতিহ্য সার্কাস শিল্পকে মাঠে শো করার অনুমোদন প্রদান করা হোক। আমরা মানুষের দরজায় যেতে পারছি না। পরিবার-পরিজন নিয়ে কাজ করে খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই।  শো করার অনুমতি পেলে এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৭ হাজার মানুষ বেঁচে যাবে। নয়তো কর্মহীন থেকে অভাব-অনটন আর  অসুখ-বিসুখে বিলীন হয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর