প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ‘এখন আমাদের দেশে নানা ধরনের সিনেমা তৈরি হচ্ছে, সিনেমায় শিশুদের সেভাবে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু শিশুশিল্পীদেরও যে সিনেমায় গুরুত্ব আছে সে বিষয়টি হয়তো এখনকার নির্মাতারা বোঝেন না। এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, কারণ আমাদের দেশের দর্শক সব সময়ই পারিবারিক গল্পের সিনেমা পছন্দ করেন। আর পারিবারিক গল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো শিশুশিল্পী। আমার নির্মিত কাবুলিওয়ালা, আম্মাজান, ধরসহ প্রায় প্রতিটি সিনেমাতেই শিশুশিল্পীর চরিত্র ছিল এবং দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করেছে বলেই এসব সিনেমা সুপার হিট ব্যবসা করেছিল।’
কমপক্ষে ৭০ ও ৮০ দশকের সিনেমার কথাই যদি বলা হয় তখন দেখা যায় অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, ডুমুরের ফুল, ডানপিটে ছেলে, লাল কাজল, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, পুরস্কার ও দীপু নাম্বার টু সিনেমাগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেছিল। এসব সিনেমায় অন্য সব চরিত্রের মতো শিশু চরিত্র গল্পে হাজির হতো নায়কের মতো। মাস্টার সুমন, মাস্টার শাকিলের মতো শিশুশিল্পীরা পর্দা ভাগাভাগি করে নিতেন দাপুটে নায়কদের সঙ্গে। যেখানে নায়ককে ছাপিয়ে শিশু চরিত্রই হয়ে উঠেছে যেন মহানায়ক। মাস্টার সুমন, মাস্টার শাকিল সেসব শিশু অভিনয় শিল্পীদের প্রতিনিধি। ৭০ ও ৮০ দশকের রুপালি পর্দায় রাজত্ব করেছেন তারা। গল্পে তাদের উপস্থিতি কখনো দর্শকদের হাসিয়েছে আবার কখনো করেছে বিষাদের সঙ্গী। পরবর্তীতে অন্তরা, মাটির ময়নার অনু এবং সবশেষ শিশুশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন দীঘি। ২০০০ সালের প্রথমদিকের শিশুতোষ গল্পের সিনেমা? আমার বন্ধু রাশেদ, দর্শকমন জয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সম্মানও পেয়েছিল।
তবে কালের যাত্রায় হারিয়ে গেছেন তারা। এরপর তৈরি হয়নি নতুন কোনো শিশুশিল্পী। এখনো প্রতি বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শিশুশিল্পী ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়। তবে সেই অর্থে জনপ্রিয় হয়নি কেউ মাস্টার সুমন অথবা মাস্টার শাকিলের মতো। গল্পে কী ভূমিকা ছিল শিশু চরিত্রের? কেনইবা গল্প থেকে হারিয়ে গেল শিশু চরিত্র?
এ বিষয়ে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান বলেন, ‘সামাজিক সিনেমার ভিতর প্রচলিত ধারার যে কমার্শিয়াল এলিমেন্টসগুলো, ততটা রাখা যায় না, যার কারণে চরিত্রগুলোই সিনেমা থেকে বাদ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এখনকার সিনেমাগুলোতে সামাজিক পারিবারিক গল্প ওইভাবে বলতে চায় না। এটা একটা সংকট, আর এ সংকটের একটি বহির্প্রকাশ হচ্ছে এ ধরনের শিশু চরিত্র নাই হয়ে যাওয়া। তাদের নিয়ে এখন নির্মাতারা সেভাবে ভাবছেও না। কিন্তু শিশু-কিশোর সবার কাছেই প্রিয়। এ জন্য সিনেমার গল্প, কাহিনি ও সংলাপে শিশুদের জায়গা রাখতে হবে। সিনেমায় শিশুদের সুযোগ দিতে হবে।’
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে না। কারণ, এ ব্যাপারে নির্মাতাদের আগ্রহও কম। চিত্রনাট্য সংকট, সেইসঙ্গে শিশুদের নিয়ে সিনেমা বানানোর ব্যাপারে এখনকার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি বছর সরকারিভাবে শিশুতোষ সিনেমা বানানোর জন্য অনুদান দেওয়া হচ্ছে। সেই টাকা নিয়েও সেভাবে শিশুতোষ সিনেমা বানানো হচ্ছে না।’
এ মুহূর্তে শিশু চরিত্রের গুরুত্ব বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে- এ প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, ‘যদি শিশু চরিত্র আর্কষণীয় করে তোলা যায়, তাহলে শিশুরা নিশ্চয়ই সেই সিনেমা দেখার জন্য বাবা-মাকে নিয়ে আসবে। এজন্য এখনকার নির্মাতাদের উচিত শিশুদের নিয়েও ভাবা।’
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, ‘আমি মনে করি প্রকৃত শিশুশিল্পীদের শুধু শিশু হিসেবে মূল্যায়ন না করে, একজন শিশুশিল্পীকে তার কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা উচিত। শিল্পী হিসেবে কাজের প্রতি তার ত্যাগ ও স্পৃহাকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন, রাষ্ট্রীয়সহ সব পর্যায়ে। আমাদের দেশে শিশুশিল্পীদের শুধু শিশু হিসেবেই মূল্যায়ন না করে, বড়-ছোট ভেদাভেদ না করে, তার মেধার মূল্যায়ন করে সে যেন ভবিষ্যতে এ শিল্পের একজন অংশীদার হতে পারে সেজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা করা দরকার।’
‘এ মুহূর্তে শিশু চরিত্রে গুরুত্ব বাড়াতে বড়দের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, যেমন সরকারি- বেসরকারিভাবে শিশুশিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন করে তাদের পুরস্কৃত করা উচিত’ বলে মনে করেন তিনি।