চলচ্চিত্রে নতুন মুখরা এখন আর স্থায়িত্ব পাচ্ছেন না। কিন্তু কেন? নায়করাজ রাজ্জাক আফসোস করে বলেন, আমরা অভিনয় আর চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে এই জগতে এসেছি। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আজ এ অবস্থানে পৌঁছেছি। দুঃখ হয় এখনকার কিছু শিল্পীর অবস্থা দেখে। অভিনয় নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এসেই তারকা হতে চান। গাড়ি-বাড়ি আর অর্থবৈভব গড়তে চান। ফলে তারা আর শিল্পী হয়ে ওঠেন না। আমরা শুটিংয়ে গিয়ে মাটিতে ঘুমিয়েছি। ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করিনি। সময় পেলেই স্ক্রিপ্ট পড়েছি আর চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণের চেষ্টা করেছি। আর এখনকার শিল্পীরা সুযোগ পেলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোনে গল্প করেন। এসি রুম বা মানসম্মত হোটেল নয়, যখন যেখানে পেরেছি থেকেছি। আমাদের কাছে কাজই ছিল মুখ্য। অন্য কিছু নয়। এখনকার শিল্পীরা ফাইট, ডান্স এবং অভিনয় না শিখেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন। একশ্রেণির নির্মাতাও তাদের সহজে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। এতে ফলাফল থাকছে শূন্য। চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকট আর কাটছে না।
নায়করাজের এই আক্ষেপের জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে একদিকে চরম শিল্পী সংকট, অন্যদিকে যেসব শিল্পী আসছেন এক বা দুই ছবিতেই তাদের ক্যারিয়ার শেষ হচ্ছে। চলচ্চিত্রে সুবিধা করতে না পেরে অনেকে আবার মানহীন নাটক ও বিজ্ঞাপনে নামমাত্র অর্থে কাজ করে মিডিয়ায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অনেক মেয়ের মুখে শোনা যায়, 'চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গেলে নির্মাতারা কুপ্রস্তাব দেন। অথবা গল্প বা চরিত্র পছন্দ হয়নি কিংবা অমুকের বিপরীতে অভিনয় করতে চাই না বলে ছবিটি ছেড়ে দিয়েছি।' ছেলেদের অভিযোগ, 'নির্মাতারা বড় অঙ্কের টাকা চান। টাকা দিতে পারি না বলেই ছবি পাচ্ছি না।' অভিনয়ের 'অ'ও জানেন না এমন অনেকে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে এসব খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অনৈতিক কাজও করে যাচ্ছেন। ফলে প্রায়ই অনেকের কার্টপিস ভিডিও ফাঁস হচ্ছে। শুধু দেশে নয়, নামেমাত্র অনেক শিল্পীকে আবার নাটকের নামে ঘন ঘন বিদেশেও যেতে দেখা যায়। এ নিয়ে মিডিয়ায় একটি কথার প্রচলন আছে। আর তা হচ্ছে 'বিনা পয়সায় বিদেশ যাওয়ার লোভে নির্মাতার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হয়ে একদিকে নির্মাতার মনোরঞ্জন, অন্যদিকে বিদেশের হোটেলে কলগার্লের কাজ করছেন অনেকে। ফিরছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে। অনেক শিল্পী আবার শুটিংয়ের নামে আদম পাচার ও দালালির পথ বেছে নিচ্ছেন। মানে চলচ্চিত্র নয়, চলচ্চিত্রের নামে অন্য কাজে গা ভাসিয়ে এই শিল্পের গায়ে কালিমা লেপন করছেন তারা।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমানের কথায় নব্বই দশকের মধ্য সময় পর্যন্ত এ অবস্থা ছিল না। কারণ তখনকার নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেই আসতেন। অন্য কোনো উদ্দেশ্য তাদের থাকত না। তাই পাকা জহুরীর মতো প্রকৃত
শিল্পী বেছে নিতেন। আর এসব শিল্পী এখনো দর্শক হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, চলচ্চিত্রে শিল্পী হিসেবে সর্বশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এমন শিল্পীর সংখ্যা নগণ্য। ২০১২ সালে আসা মাহি ও বাপ্পি ছাড়া আর তেমন কাউকে সফল হিসেবে চোখে পড়েনি। কারণ একটিই- নির্মাতারা তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারছেন না এবং শিল্পীদেরও কাজের প্রতি আগ্রহ নেই। অর্থ-বিত্তই তাদের কাছে প্রধান। অনেক নির্মাতা আবার কম বাজেটে ছবি বানাতে এসে স্বল্প পারিশ্রমিকে বা বিনা পয়সায় নামমাত্র শিল্পী বা নতুন মুখ নিয়ে কাজ করছেন। ফলে শিল্পীও তৈরি হচ্ছে না এবং সেসব ছবিও মুখ থুবড়ে পড়ছে।
খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ-এর মতে, চলচ্চিত্র বা যে কোনো কাজ হোক, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ঠিক না থাকলে তা ব্যর্থ হতে বা অকাজে পরিণত হতে বাধ্য। বর্তমানে অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই এই অবস্থা।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা হাফিজউদ্দীন বলেন, প্রায় সময় দেখি ঘটা করে কোনো প্রতিষ্ঠান বা টিভি চ্যানেল ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। জমকালো গ্রান্ড ফিনালের মাধ্যমে কাউকে আবার চ্যাম্পিয়নও বানানো হয়। পরে আর তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এসব অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
চলচ্চিত্রকারদের কথায়, নামসর্বস্ব ক্ষণস্থায়ী এসব শিল্পী চলচ্চিত্রে কাজ না পেলেও সারা দিন এফডিসি বা অন্য সব শুটিং স্পটে ঘুরে বেড়ান। কাজের কথা জানতে চাইলে জবাব- এই তো, শিগগিরই অমুকের ছবির কাজ শুরু করছি। আরও বেশ কয়েকজন নির্মাতার ছবিতে কাজের কথা চলছে। চলচ্চিত্রকাররা বলেন, আসলে সবই মিথ্যা। তারা এভাবে না ঘুরে কাজ শেখার দিকে মনোযোগী হলে হয়তো কিছু একটা করতে পারতেন। এতে শিল্পী সংকটও কাটত। চলচ্চিত্রকারদের ভাষায়, এসব 'করে খাচ্ছি' টাইপের শিল্পীরা চিত্রজগৎকে নানাভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলছেন।