চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী কল্যাণী ঘোষ। গান তাকে এখনো চির সবুজ করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কণ্ঠের জাদু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছে। মাইজভাণ্ডারী গানেও রয়েছে তার আকাশ ছোঁয়া শ্রোতাপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয় শিল্পীর দিনকাল কেমন কাটছে। তা জানতে তার মুখোমুখি হয়েছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ
কেমন আছেন?
ভালো থাকিবার কথা নয়, গান তো ইত্তারি আর অ্যালবাম, সিডি আর ক্যাসেটড বাইর ন হয়। গানের বেগ কোম্পানি বন্ধ হই গেইয়ে। আইজকাইল মোবাইলত গান বাইর হয়, মানুষ দুই তিন টেয়া খরচ করি সহজে গান হুনিত পারে। আরা পইসা ন পাই। আর রক্তত চাঁটগাইয়া গান মিশি গেইয়ে, আঁই মরি গেলেও গান আরে আজীবন বাঁচাই রাখিবো। [ভালো থাকার কথা নয়, গানতো এখন আর সিডি, অ্যালবাম আর ক্যাসেটে বের হয় না। গানের সব কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। আজকাল মোবাইলে গান বের হয়, মানুষ দু-তিন টাকা খরচ করে সহজে গান শুনতে পারে। আমরা আর পয়সা পাই না। আমার রক্তে চট্টগ্রামের গান মিশে গেছে। আমি মরে গেলেও গান আমাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে]।
তাহলে এখন সময় কাটছে কীভাবে?
চট্টগ্রাম টেলিভিশন আর বেতারে গান করি। মাঝে মধ্যে স্টেজে আর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই। ঢাকায় স্বামী অভিজিৎ চক্রবর্তী তবলাবাদক হিসেবে আর একমাত্র ছেলে মিঠুন চক্রবর্তী চাকরি ও পাশাপাশি গান করে আর পারকিউশান বাজায়। এইতো এভাবে সময় সংসার কোনোভাবে চলে যাচ্ছে?
মাইজভাণ্ডারী গানেও রয়েছে আপনার সমান শ্রোতাপ্রিয়তা, কিছু বলুন—
আসলে মাইজভাণ্ডারী গান শুরু হয়েছিল আমার মাধ্যমে। আমি যখন এই গানে আসি তখন তেমন কেউ মাইজভাণ্ডারী গান করতেন না। মেয়েদের তো এই গান করার প্রশ্নই আসে না। আর হিন্দুদের তো নয়ই। ১৯৭৭ সাল থেকে মাইজভাণ্ডারী গান শুরু করি। তখন এই গানের শ্রোতারা আমাকে রানীর মতো দেখত। অনেকে অবশ্য হিন্দু মেয়ে মাইজভাণ্ডারী গান করছি বলে আপত্তি জানালেও এই গানে আমার ভক্তের সংখ্যা ছিল ৭৫ ভাগ। তাই আর অসুবিধা হয়নি।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অবস্থা এখন কেমন?
আসলে এখানকার সিনিয়র শিল্পীদের মধ্যে আমি আর সঞ্জীব ছাড়া আর কেউ তেমন বেঁচে নেই। আঞ্চলিক গানের অবস্থা তেমন ভালো নয়। স্টেজ হচ্ছে গানের প্রধান স্থান। এখন প্রচুর টিভি চ্যানেল হয়েছে। তাতে গানের লাইভ প্রোগ্রামও হচ্ছে। এতে করে শ্রোতারা আর স্টেজে গান দেখে না। ফলে শিল্পীরা কষ্টে পড়ে। এখন গান হয়ে গেছে দেখার বিষয় আর যন্ত্রনির্ভর। এতে প্রকৃত শিল্পীরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
মোবাইল আর টিভি লাইভের গান নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?
এক্ষেত্রে একতার অভাব রয়েছে। সবাই শুধু মুখে বলে, ঐক্যবদ্ধভাবে অনিয়ম প্রতিরোধ করে না। ফলে অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। এটি দুঃখজনক।
সিনিয়র শিল্পীদের গান নতুন শিল্পীরা কেমন গাইছে?
এখনকার শিল্পীরা গানের মুখটা শুধু ঠিক রেখে অন্তরা, সুরসহ সবকিছু নিজেদের মতো করে গাইছে। এতে গানের যথার্থতা হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন আমার পাঞ্জাবিওয়ালা গান, যেটি সুজেয়শ্যাম সুর আর সংগীতায়োজন করেছিলেন সেটির মৌলিকত্ব দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছিল বলে সেটি কালজয়ী হয়ে গেছে। পরে এ প্রজন্মের শিল্পীরা নতুনভাবে গানটি গাইলেও এর অরিজিনালিটি নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটি দুঃখ হলো এখনকার শিল্পীরা সিনিয়রদের গান গাইতে গেলে তাদের নাম বলে না। এটি অশ্রদ্ধার নামান্তর। যা কাম্য নয়।
তাহলে বলা যায় সিনিয়রদের মনে প্রচুর ক্ষোভের জায়গা তৈরি হয়েছে?
অবশ্যই, যারা গানকে প্রাণ দিয়ে গেছেন তাদের কথা পরে আর কেউ মনে রাখে না। চট্টগ্রামের দুই কিংবদন্তি শিল্পী শেফালী ঘোষ আর শ্যাম সুন্দর বৈষব কিংবা গফুর হালিকে এখন কে কতটা মনে রেখেছে? আমাকেও একদিন সবাই ভুলে যাবে। এ কষ্ট নিয়েই এক দিন চলে যেতে হবে। [দীর্ঘ নিঃশ্বাস]
সরকারিভাবে আঞ্চলিক গানকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে আপনার ধারণা?
আমার মতে আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা সবসময়ই সরকারের তরফ থেকে অবহেলিত আর উপেক্ষিত। সরকারিভাবে দেশে বিদেশে যেসব গানের অনুষ্ঠান হয় তাতে আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের ডাকা হয় না বললেই চলে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের শিল্পীরা কোনো সুযোগ সুবিধা পান না। আমাদের গান অন্যদের দিয়ে গাওয়ানো হয়। এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে? কেন, আমরা তো এখনো বেঁচে আছি।
ব্যক্তিগতভাবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অমরত্বের জন্য আপনার উদ্যোগ কী?
সংগীতকার আবদুল গফুর হালির নামে একটি একাডেমি হচ্ছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তার সৃষ্টি ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অমরত্বের জন্য কাজ করে যাব। সবাইকে অনুরোধ করব গীতিকার, সুরকার, আর শিল্পীর নাম যেন বিকৃত বা বিস্মৃত না করে।