নীলফামারির হালিমা (ছদ্ম নাম) তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বছর দেড়েক আগের কথা। সাত ভাইবোনের সংসারে একমাত্র হালিমাই প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলের বারান্দায় পা রেখেছিল। দিনমজুর বাবার সংসারের অনটন মেটাতে স্কুল থেকে ফিরে এক প্রতিবেশীর গরুর ঘাস জোগাড় করার কাজ করতো ১১ বছরের মেয়েটি। তবুও স্কুলে সবার থেকে রোল নম্বরে এগিয়ে থাকতো সে। আকাশ থেকে প্লেন যেতে দেখলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। স্বপ্ন ছিল একদিন বিমান চালানোর। সেটা কতটুকু সম্ভব হতো সেটা হয়ত ভবিষ্যৎ বলে দিত। তবে স্কুলের শিক্ষকরা হালিমার বাবাকে বলেছিলেন, মেয়েটিকে দেখে রাখতে। প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পেলে সে অনেকদূর যাবে- এমনটাই ধারণা ছিল শিক্ষকদের। আজ সেই কথাই মনে করে দু'চোখের পাতা ভিজে ওঠে দিনমজুর কায়েসের। হালিমার স্বপ্ন আজ চাপা পড়েছে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে। মাস তিনেক আগে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে চিরতরে সবাইকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছে হালিমা। শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানটিও পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি।
বছর দেড়েক আগে সৌদি প্রবাসি এক পাত্রের সঙ্গে অনেকটা জোর করেই হালিমার বিয়ে দেন তার বাবা। বিয়েটা হয় টেলিফোনে। প্রবাসি পাত্র হালিমার বড় ভাইকে বিদেশ নিয়ে যাবে। সংসারে অভাব-অনটন থাকবে না, হালিমার পড়াশুনাও বন্ধ হবে না- এমন নানা স্বপ্নে বিভোর হালিমার বাপ কন্যার বয়সের কথা না ভেবেই তাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেন। বিয়ের দু'মাস পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরে একমাস থেকেই বিদায় নেয় হালিমার স্বামী। রেখে যায় হালিমার গর্ভে নিজের চিহ্ন। কিন্তু সেই চিহ্ন বহন করার সামর্থ্য তখন ছিল না হালিমার। তবু অপরিপক্ক গর্ভে বড় হতে থাকে হালিমার সন্তান। আর হালিমা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয় করুণ পরিণতিতে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা-সন্তান দু'জনই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
এমন হাজারো হালিমা অধ্যায়ের করুণ সমাপ্তি হচ্ছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়ত। বাল্যবিয়ের হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে চতুর্থ। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মতে, এ ক্ষেত্রে বিশ্বে নাইজার, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং চাঁদের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ইউনিসেফের মতে, ২০০৫ থেকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে শতকরা ২৯ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের আগেই। আর শতকরা ৬৫ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগেই। বাল্যবিয়ে সারা বিশ্বেই কতগুলো ক্ষতিকর পরিণতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে রয়েছে আগাম গর্ভধারণজনিত স্বাস্থ্যগত বিপদ, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের শিক্ষার নিম্নহার, অধিকতর দাম্পত্য সংঘাত এবং ক্রমাগত দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা। এসব কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত 'বাল্যবিবাহ: বাংলাদেশ' শীর্ষক ১৩৪ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে।
এতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-২৪ বয়সের মায়েদের তুলনায়, প্রসবকালীন সময়ে ১০-১৪ বছর বয়সের মেয়েদের মৃত্যুঝুঁকি পাঁচ গুণ বেশি। আর যেসব মেয়ের বয়স ১৫-১৯, তাদের মৃত্যুঝুঁকি ২০-২৪ বয়সের মহিলাদের তুলনায় দ্বিগুণ। অশিক্ষা অথবা অল্পশিক্ষার সঙ্গে বাল্যবিয়ের সম্পর্ক নিয়ে করা গবেষণায় বাংলাদেশে দেখা গেছে, যারা কোন সময়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি, তাদের তুলনায়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মেয়েদের ক্ষেত্রে যথাক্রমে শতকরা ২৪, ৭২ ও ৯৪ ভাগের অল্প বয়সে বিয়ে করার সম্ভাবনা কম। বিশ্বের সাতটি দেশে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মেয়ের ১৫ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়, তার ২৫ বছর বয়সের পরে বিয়ে হওয়া মেয়েদের তুলনায় দাম্পত্য নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বিশ্বব্যাপী প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ২০ ভাগ গরিব পরিবারের মেয়েদের, শতকরা ২০ ভাগ ধনী পরিবারের মেয়েদের তুলনায় ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে করার সম্ভাবনা বেশি। অন্য অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়নের সফল উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে নারীর অধিকারও। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৯৯১-৯২ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ৫৬.৭ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়টি জাতিসংঘকে 'চমৎকৃত' করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লিঙ্গগত সমতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘের মতে, দেশটিতে ২০০১ সালের তুলনায় ২০১০ সালে মাতৃমৃত্যু ৪০ ভাগ কমে এসেছে।
বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতার ফলে বাংলাদেশ সরকারও তৎপর হয়েছে এবং দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। লন্ডনে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কন্যাশিশু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাল্যবিয়ের হার কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেন, যাতে বলা হয়, ২০৪১ সালের মধ্যে এটি একেবারে নির্মূল করা হবে। তিনি কথা দেন, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হবে এবং ১৫-১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়েও এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা হবে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি কথা দেন, তার সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধে প্রাসঙ্গিক আইন-বাল্যবিয়ে নিয়ন্ত্রণ আইন (সিএমআরএ) পর্যালোচনা করবে, ২০১৪ সালের আগেই বাল্যবিয়ে নিয়ে একটি কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে, সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৪ সালের শেষের দিকে ১১৪ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী, যারা নিজেরাই বাল্যবিয়ের সরাসরি শিকার। এদের সঙ্গে কথা বলে, বাল্যবিয়ে বন্ধের সফলতার কথা যেমন জানা গেছে, তেমনি জানা গেছে, এ বিষয়ে সরকারের অনেক কিছুই করণীয় আছে এবং করা উচিত।
বাংলাদেশে এখন বিয়ের বৈধ বয়স হচ্ছে ছেলেদের জন্য ২১ ও মেয়েদের ১৮। ১৯২৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম বাল্যবিয়ে আইন পাস হয়। এরপর এটি বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়। ওই আইন অনুসারে ১৮ ও ২১ বছর বয়সের আগে ছেলে বা মেয়েদের বিয়ে করা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু ওই আইন খুব কমই প্রয়োগ হয়।
বিভিন্ন পরিবারকে জিজ্ঞেস করা হয়, মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত কীভাবে তারা নিয়েছে। তারা বারবার তখন নিজেদের দারিদ্র্যের কথা বলেছে। অন্যদিকে মেয়েরা জানিয়েছে, শুধু ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বাবা-মা তাদের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দারিদ্র্য, শিক্ষা ও বাল্যবিয়ে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার অনেক পরিবার মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবেও অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সাক্ষাৎকার দেয়া বেশ কিছু পরিবার জানিয়েছে, তাদের সন্তানদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়ার পেছনে দুর্যোগের বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। অন্য পরিবারগুলোও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট সংকটের কথা জানিয়েছে। যার ফলে দ্রুত বিয়ে দেয়াই মেয়ে ও পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভাল উপায় মনে হয়। হয়রানি এবং ভয়ভীতিও বাল্যবিয়ের অন্যতম বড় অনুঘটক। অবিবাহিত উঠতি বয়সের মেয়েদের নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেয় বখাটেরা। এর মধ্যে রয়েছে বিয়ের উদ্দেশ্যে অপহরণও। বাবা-মায়ের যখন মনে হয়, ওই বখাটেদের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করা সম্ভব নয়, পুলিশও সাহায্য করবে না, তখন মেয়েকে বিয়ে দেয়াই একমাত্র সমাধান মনে হয় তাদের। পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের অন্যরাও পরিবারগুলোকে প্রভাবিত করে। সমাজে মনে করা হয়, ঋতুস্রাব হওয়া মানেই মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়া। মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে বরকে যৌতুক দেয়ার বহুল চর্চিত রীতিও পরিবারগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। ভাবা হয়, মেয়ের বয়স কম হলে, বিয়েতে যৌতুকও কম দেয়া যাবে বা না দিলেও চলবে। বাংলাদেশে ছেলেরাও বাল্যবিয়ের শিকার, কিন্তু মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের বাল্যবিয়ের সংখ্যা ১১ গুণ কম।
হিউম্যান রাইটস প্রতিবেদন তৈরিতে যেসব গ্রামে গিয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই বাল্যবিয়ে কেবল গ্রহণযোগ্যই নয়, প্রত্যাশিতও। বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে বাল্যবিয়ে বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার গ্রহণ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু এ লক্ষ্য কখনোই অর্জিত হবে না, যদি সর্বক্ষেত্রে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত না করা যায়।
বিডি-প্রতিদিন/১১ জুন ২০১৫/ এস আহমেদ