শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

শাহেদ আলী হত্যার সত্য মিথ্যা

অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

১. ইতিহাসের সত্যকে মুছে ফেলা যায় না। যদি কেউ বা কারা এই অপকর্মটি করতে যান তাহলে তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হন। ১৯৫৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বিধান সভায় স্পিকার আবদুল হাকিম আসন গ্রহণ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুসলিম লীগ দলের হাশেম উদ্দিন আহমেদ প্রস্তাব তুললেন যে, আওয়ামী লীগের যে ছয়জন সদস্য পাবলিক প্রসিকিউটর পদে যোগদান করেছেন সংসদ থেকে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। কিন্তু ওই সময় পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন অর্ডিন্যান্স জারি করে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেন। উত্থাপিত প্রস্তাব নিয়ে শ্রীমনোরঞ্জন ধর বক্তব্য রাখলেন। কিন্তু একদল ক্রুদ্ধ সদস্য এখনই এ বিষয়ে স্পিকারের কাছে রুলিং দাবি করলে পাল্টাপাল্টি ন্যাপের সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী স্পিকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। এসব নিয়ে পার্লামেন্টে দাঙ্গাহাঙ্গামা বেধে যায়। স্পিকার আবদুল হাকিম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সভাকক্ষ ছেড়ে দেন।
২. তখন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী স্পিকারের শূন্য আসনে উপবেশন করেন। দেওয়ান মাহবুব আলীর প্রস্তাবের পক্ষে কংগ্রেস সদস্য পিটার পল গোমেজ স্পিকার আবদুল হাকিমকে বদ্ধ উন্মাদ ঘোষণা করে প্রস্তাব আনলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এ সময় কৃষক-শ্রমিক দলের ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) উত্তেজিতভাবে স্পিকারের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সরকার পক্ষের সদস্যরা তাকে বাধা প্রদান করেন। ২১ সেপ্টেম্বর স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার না থাকায় প্যানেল সদস্য কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা সৈয়দ আজিজুল হক সেদিন বিধানসভার মামুলি রীতিনীতি পালন করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে বিরোধী পক্ষ হট্টগোল শুরু করে।
৩. সংখ্যাশক্তির দিক থেকে তখন পরিষদে বিরোধী দল ছিল দুর্বল। সেজন্য তারা দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে। ডেপুটি স্পিকারের সভাপতিত্বে হাউস শুরু হয়। অপজিশন দলের হট্টগোল শুরু হয়। জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুল লতিফ বিশ্বাস, আবদুল মতিন, গোলাম সরোয়ার, মহম্মদ-উন-নবী চৌধুরী প্রমুখ বিরোধীদলীয় সদস্যরা সমস্বরে দাবি জানালেন, শাহেদ আলী সাহেব কালবিলম্ব না করে স্পিকারের আসন যেন ত্যাগ করেন। এমনকি কৃষক শ্রমিক দলের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার উত্তেজিত হয়ে ডেপুটি স্পিকারের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন : ‘আপনি যদি এই মুহূর্তে স্পিকারের চেয়ার না ছাড়েন তবে আপনাকে আমরা খুনই করে ফেলব।’ আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইতে আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছেন, ‘শুধু মৌখিক নয়, কায়িক। শুধু খালি-হাতে কায়িক নয়, সশস্ত্র কায়িক। পেপার ওয়েট, মাইকের মাথা, মাইকের ডান্ডা, চেয়ারের পায়া-হাতাল ডেপুটি স্পিকারের দিকে মারা হইতে লাগিল। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা করিয়া সরকার পক্ষ আগেই প্রচুর দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তারা ডেপুটি স্পিকারকে অস্ত্র-বৃষ্টির ঝাপটা হইতে রক্ষা করিতে লাগিলেন। অপজিশনের কেউ কেউ মঞ্চের দিকে ছুটলেন। তাদের বাধা দিতে আমাদের পক্ষেরও স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী দু-চারজন আগ বাড়িলেন। ... নিজ জায়গায় অটল-অচল বসিয়া-বসিয়া সিনেমায় ফ্রি স্টাইল বক্সিং বা স্টেডিয়ামে ফাউল ফুটবল দেখার মতো এই মারাত্মক খেলা দেখিতে লাগিলাম।’ বিরোধীদলীয় চক্রান্তকারীদের ইটপাটকেলে ডেপুটি স্পিকার আহত হন। তিনি ছিলেন ডায়বেটিস রোগী। আহত অবস্থায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরের দিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৪. শাহেদ আলী হত্যা ছিল একটি পরিকল্পিত চক্রান্তের পরিণতি। ইস্কান্দার মির্জা কেএসপি সদস্যদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি তাদের উসকানি দেন যেভাবে হোক পার্লামেন্টে দাঙ্গা হতে হবে, যাতে কেএসপি ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সঙ্গে মুখ্য যোগাযোগ রেখেছেন মোহন মিয়া। তারা সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানের ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নে লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করেছেন। জেনারেল আইয়ুব খান মার্কিন সিআইএ প্রধান এ্যালেন ড্যালেসের সঙ্গে একমত হন যে, পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক শাসন হবে উত্তম। প্রকৃত অর্থে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের বিপুল গণরায় বানচাল, বাঙালি জাতির অধিকার শোষণ-বৈষম্যের অবসানে এবং স্বশাসনের দাবিকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে এটা ছিল এক গভীর চক্রান্ত। সেজন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সামরিক আমলে তা কার্যকর থাকেনি। শাহেদ আলী ছিলেন আওয়ামী লীগ দলের সদস্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বা অন্য কোনো সদস্য চেয়ার ছুড়ে তাকে হত্যা করেছেন এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না। আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন, ‘শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপজিশনের ঢিল-পাটকেলে অথচ পূর্ববাংলার দুশমনেরা তখনও বলিলেন ও আজও বলেন আওয়ামী লীগ শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে।’ এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতির মানসিকতা ত্যাগ না করলে কখনো কেউ দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবেন না। সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে বিশালত্ব অর্জন করা যায় না। লেখক : ’৭২-এর খসড়া সংবিধানপ্রণেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর