বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় এড়াতে পারে না

ফের জাসদ বিতর্ক

-------কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফের জাসদ বিতর্ক

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় জাসদ পরোক্ষভাবে এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক মন্ত্রী কর্নেল  (অব.) জাফর ইমাম বীববিক্রম। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ’৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদের সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে চূড়ান্ত অপমান করে বেইমান বলার ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে গালি দেওয়াই ছিল তাদের স্লোগান। ঢাকার মাটিতে মিটিং করে জাসদ স্লোগান দিত— ‘বাংলার বেইমান, শেখ মুজিবুর রহমান।’ সদ্য স্বাধীন দেশের জাতির জনককে বিতর্কিত করতে এর চেয়ে বড় স্পর্ধা আর কী হতে পারে। সবমিলিয়ে এই সময়গুলোতে জাসদ যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল তা-ই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকে ত্বরান্বিত করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন সময়ে খোন্দকার মোশতাক যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন সেই ষড়যন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশে ঘনীভূত হয়েছিল জাসদ সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণেই। কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম আরও বলেন, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন যারা মুজিব বাহিনীতে ছিলেন তাদেরই একটা বড় অংশ জাসদ সৃষ্টি করেছেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রথম আঘাত। মূলত আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ ও নেতা-কর্মী জাসদে যোগ দেয় যা পরবর্তীতে গণবাহিনীতে রূপ নেয়। এর ফলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এ ধারাবাহিকতায় ষড়যন্ত্র বেগবান করে মোশতাক চক্র। ৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মোশতাককে মন্ত্রিসভায় রাখলেন; এতে আমরা বিস্মিত হই। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মোশতাকের ষড়যন্ত্রের কথা হয়তো জানানো হয়নি তাকে। পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টির মতো জাসদ রূপ নেয় গণবাহিনীতে। ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে ঈদের নামাজে এমপি হত্যার মতো কার্যকলাপ চালায় তারা। দেশব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করে এই গণবাহিনী। রাজনৈতিক এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে ত্বরান্বিত করেছে। ফলে মোশতাকের মতো ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জাসদ জড়িত না থাকলেও পরোক্ষভাবে এ হত্যার দায় এড়াতে পারে না তারা। তবে এটাও সত্য, সেই দিনের সাংগঠনিকভাবে মজবুত জাসদ এখন আর নেই।’ বীরবিক্রম জাফর ইমামের লেখা ‘দাম দিয়ে কিনেছি এ বাংলা’ বই-এ মোশতাকের ষড়যন্ত্র ও জাসদের হঠকারী ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ‘মুজিব হত্যা : ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার পরপর সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধা, সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা এক কথায় স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিগুলোকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। শুরুতে এই প্রয়াসের বিপক্ষে কেউ ছিল না, কারণ সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল। কিন্তু এ প্রয়াস সফল হলো না। লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নে ছিল তত্পর, অপেক্ষায় ছিল সুযোগের। তখন সদ্য, স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি শিশু রাষ্ট্রের ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানান সমস্যা। সেগুলো গুছিয়ে আনতে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনীয় সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের কারণে তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে সরকারের ব্যর্থতা ছিল না তা নয়— অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সে সময়ের ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু সার্বিক মূল্যায়নে দেখা যাবে যে স্বাধীনতা প্রাপ্তির তিন-চার বছরের মধ্যে সব সমস্যা সমাধান করে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন ছিল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমি মনে করি, সফল বা ব্যর্থ হয়েছে এ মূল্যায়নের জন্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য সরকারের যে সময়ের প্রয়োজন ছিল সেই সময় তৎকালীন সরকার পাননি। সব মিলিয়ে তৎকালীন সময়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্তি, ষড়যন্ত্রকারীদের নীল নকশা বাস্তবায়নে তত্পরতা এবং এসবের ফলশ্রুতিতে আমরা দেখলাম জাসদের আত্মপ্রকাশ এবং তাদের বিপ্লবী ভূমিকা। ১৫ আগস্ট ’৭৫ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, মোশতাকের ক্ষমতা দখলের হীন ষড়যন্ত্র, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে অসংখ্য অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী ও জাসদের আত্মপ্রকাশ।’ বইয়ে আরও বলা হয়, ‘এদের (ষড়যন্ত্রকারীদের) মধ্যে অনেকে যুদ্ধকালীন সময়ে এবং পরে ক্ষমতা দখলের গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, শুধু অপেক্ষায় ছিল সময়ের ও সুযোগের। যুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ে তার পরামর্শ দাতাদের অনেকের অনেক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ সঠিক ছিল না। এদের মধ্যে অনেকে আবার হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করেছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধু বিতর্কিত হয়ে ওঠেন এবং এতে করে বিভিন্ন মহলে হিংসা ও বিদ্বেষের বীজ রোপিত হয়। ... বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যে এদের তৎকালীন কর্মকাণ্ড পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে হত্যা ষড়যন্ত্রের পরিস্থিতি ও পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে জোগান দিয়েছিল।’

 

 

সর্বশেষ খবর