বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

যখন যেমন তখন তেমন থাকুন

সমরেশ মজুমদার

যখন যেমন তখন তেমন থাকুন

—কেমন আছেন সমরেশ?

—খুউব ভালো, ভালো আছি। মানে সেরকমই মনে হচ্ছে।

—মনে হচ্ছে মানে? পরিষ্কার বুঝতে পারছেন না?

—দূর! মনে হচ্ছে মানে, মন বলছে ভালো আছি। এর মধ্যে বোঝা না বোঝার  প্রশ্ন আসছে কেন? —এই পৃথিবীর খুব কম মানুষ আপনার মতো এমন কথা বলতে পারে! —আপনি বোধহয় অঙ্কটা ঠিকঠাক শেখেননি। কম মানুষ, ধরে নিচ্ছি শতকরা দশ ভাগ মানুষ আমার মতো ভালো আছি বলবে। তাদের মধ্যে তিন ভাগ বলবে আমারই মতো, খুউব ভালো। এই দশ ভাগের বাইরে নব্বই ভাগ মানুষ পৃথিবীতে বাস করেন তারা নিশ্চয় ভালো নেই। তাদের জন্য আমি দুঃখিত।

—আপনি কী করে ভালো আছেন তা বুঝতে পারছি না। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, পরিবর্তন এবং প্রত্যাবর্তনের লড়াই চলছে। একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে আপনাকে যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে। আর সেটা নেওয়া মাত্র আপনি দুশ্চিন্তায় পড়বেন।

—দূর মশাই, আমি ওসব ভাবি না। পরিবর্তন পরিবর্তন করে যারা চেঁচাচ্ছেন তাদের কথা কানে ঢোকাই না। কীসের পরিবর্তন? তারা যদি জিতে ক্ষমতায় আসেন তাহলে ভারতবর্ষে সংবিধান পাল্টাতে পারবেন? পারবেন না। ওই সংবিধান যে পদ্ধতিতে দেশ শাসন করতে বলেছে তাই করতে হবে। ওই আইএএস, বিসিএস ইত্যাদি অফিসারদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। ওই পুলিশদের ছাঁটাই করে পরিবর্তিত পুলিশ আনতে পারবেন না। উল্টে প্রতিদিন মিছিল এবং বন্ধের মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হবে। তার ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা ভালো কাজ প্রথম বছরে করলেও বুঝতে পারবেন সংসদীয় রাজনীতি হলো একটা মুদ্রার মতো, দুদিকে দুটো ছবি থাকে। কিন্তু টস করতে শূন্যে ছুড়ে দিলে এমন চরকি খায় যে দুটো চেহারা গুলিয়ে গিয়ে এক হয়ে যায়।

—তার মানে, এসব নিয়ে আপনি একটুও চিন্তায় নেই।

—একদম নয়। যখন যেমন আমি তখন তেমন থাকাই পছন্দ করি। মশাই, সমুদ্রে স্নান করতে নেমে যখন দেখেন বেশ বড় ঢেউ ছুটে আসছে তখন আপনি কী করেন? সোজা দাঁড়িয়ে থাকেন? তাহলে দেখতে হবে না। ঢেউ এমন আছাড় মারবে বালিতে যে হাড়গোড় ভেঙে হাসপাতালে চলে যাবেন। সবাই যা করেন, ঢেউ এলে তার মাথার ওপর লাফিয়ে ওঠেন, সেটা নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। অথবা মোক্ষম মুহূর্তে এমনভাবে ডুব মারেন যে, ওটা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে আপনাকে না ছুঁয়ে। ওটাই হলো, যখন যেমন তখন তেমন।

—বেশ, অন্য কথা বলি। জিনিসের দাম যেভাবে হু হু করে বাড়ছে, কীভাবে ম্যানেজ করছেন? কষ্ট হচ্ছে না?

—একদম নয়। খাওয়া-দাওয়ার ধরন বদলে ফেলেছি। একশো গ্রাম চিকেন এনে স্টু বানাই। চার-পাঁচ রকম সবজি বেলা ১১টার সময় কিনে এনে বয়েলড ভেজিটেবল বানিয়ে নিই। পাড়ার ঠাকুরের দোকান থেকে ছটা রুটি ছ’টাকায় কিনলে দুজনের বেশ চলে যায়। টোটাল খরচ কুড়ি টাকার মধ্যেই হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছেন, রেডমিট খাবেন না। অতএব পাঁঠা, খাসির মাংস বন্ধ। মাছ খেতে খুব ইচ্ছে হলে হোম ডেলিভারিকে ফোন করে দিই। ওরা চল্লিশ টাকায় যা দেয় তাতে দুজনের দিব্যি হয়ে যায়। এবার ভাবছি মকাই কি রুটি, শর্ষে কি শাক আর আচার ট্রাই করব। ভারতবর্ষের কয়েক কোটি তো তাই খেয়ে চমৎকার আছে।

—বাইরে যান? ট্রেনে? নাকি প্লেনে?

—যখন যেমন পাই।

—টিকিট কাটেন লাইন দিয়ে? ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হয় না?

—না। বাড়িতে বসে নেটে টিকিট কাটি। যেদিন কনফার্মড পাই সেদিন যাই।

—গল্প-উপন্যাস পড়েন?

—চুটিয়ে!

—মনে হয় না সাব স্ট্যান্ডার্ড? আগে, এই সেদিন রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর বা সমরেশ বসু যেমন লিখতেন তার ধারে-কাছে কেউ নেই!

—এই রে! আমি যখন রুটি খাই তখন তো ভাতের স্বাদ কেমন ভাবি না, যখন ভাত খাই তখন পোলাও খাচ্ছি না বলে আফসোস করি না। তাছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েরা তো চমৎকার লিখছে। সত্যি কথা, সাহস নিয়ে লিখছে।

—আচ্ছা এই যে, রাস্তাঘাটে মেয়েরা প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে হাঁটছে, সিটি সেন্টারে গেলে অনেককেই শর্টস পরে দেখতে পাবেন। আপনার খারাপ লাগে না?

—পাগল! ওদের মধ্যে কোনো কপটতা নেই, যে যার ফিগার দেখাচ্ছে। আমাদের অল্প বয়সে বা তার আগের মেয়েরা কাপড় দিয়ে শরীর এমনভাবে ঢেকে রাখতেন যে, বেঢপ আর ছিমছাম একাকার হয়ে যেত। বিয়ের পর অনেকেরই ভুল ভাঙত। এখন সেই সম্ভাবনা নেই। ভালো।

—তার মধ্যে সত্যি ভালো আছেন। ভালো থাকার জন্য কোনো উপদেশ?

—ওই যে বললাম, যখন যেমন তখন তেমন থাকুন। ভালো থাকবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর