মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর ৬ মাস। তার লাশ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে রাখা আছে। আজ এই মহানায়কের পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে মরদেহ দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তার মৃত্যুতে গোটা চলচ্চিত্র অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাতিল করা হয়েছে আগামী তিন দিনের শুটিং। সহকর্মীদের কাছ থেকে শেষ বিদায়ের জন্য আজ (মঙ্গলবার) তার মরদেহ দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে আনা হবে। নায়করাজের ছোট ছেলে খালিদ হোসাইন সম্রাট জানান, গতকাল বিকালে হঠাৎ বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। হার্ট অ্যাটাক হওয়া অবস্থায় নায়ক রাজ্জাককে বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিত্সক জানান নায়করাজ আর বেঁচে নেই। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইমার্জেন্সি বিভাগে যখন পরিবারের সদস্যরা নিয়ে আসেন তখন  তার নাড়ি (পালস) ও রক্তচাপ (ব্লাড প্রেশার) পাওয়া যাচ্ছিল না। কার্ডিয়াক ইমার্জেন্সি বিবেচনা করে সঙ্গে সঙ্গেই কোড ব্লু ঘোষণা করা হয়। কার্ডিয়ো পালমোনারি রিসাসিটেশন দিয়ে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করা ও জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে ৪৫-৫০ মিনিট চেষ্টা করা হয়। এই প্রচেষ্টা চলাকালে ইউনাইটেড হাসপাতালের চিফ কার্ডিওলজিস্ট নায়করাজের পাশে ছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নায়করাজ রাজ্জাক কয়েক বছর ধরেই ইউনাইটেড হাসপাতালের এই চিফ কার্ডিওলজিস্ট ডা. মোমেনুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হৃদরোগ ছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ মাত্রায় ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। এর আগেও তিনি এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং আইসিইউতে যন্ত্রের সহায়তায় শ্বাস-প্রশ্বাস নেন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, ‘নায়করাজ রাজ্জাক তার স্ত্রী লক্ষ্মী (খায়রুন নেসা), তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং মেয়ে ময়নাকে রেখে গেছেন। তার অপর মেয়ে শম্পা আগেই মারা গেছেন। এর মধ্যে বাপ্পী ছাড়া বাকি সবাই গতকাল হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। ছোট ছেলে সম্রাট জানান, মেজ ভাই বাপ্পী কানাডায় আছেন। তিনি রাতে জানাবেন, মঙ্গলবার ফিরতে পারবেন কিনা। তবে বাপ্পী না ফিরতে পারলেও মঙ্গলবারই দাফন করা হবে।’

জানা যায়, ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রায় ১৫ দিন কোমায় ছিলেন রাজ্জাক। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছে তাকে।

বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবন : নায়করাজের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার নাকতলায়। ছাত্র অবস্থা থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন। চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বারের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে জহির রায়হান তাকে নায়ক করে নির্মাণ করেন ‘বেহুলা’। প্রথম ছবিতেই সাফল্য। ১৯৭৭ সালে পরিচালনায় হাতেখড়ি তার। নির্মাণ করলেন ‘অনন্ত প্রেম’। প্রথম পরিচালনাতেও সফলতা পেয়ে যান চলচ্চিত্রের এই মহারাজা। তার অভিনীত ছবিগুলোর অন্যতম হচ্ছে ‘বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, জীবন থেকে নেয়া, নাচের পুতুল, অশ্রু দিয়ে লেখা, ওরা ১১জন, অবুঝ মন, রংবাজ, আলোর মিছিল, কি যে করি, বাদশাহ, গুণ্ডা বাহাদুর, অনন্ত প্রেম, অশিক্ষিত, অগ্নিশিখা, ছুটির ঘণ্টা, মহানগর, বড় ভালো লোক ছিল, চন্দ্রনাথ, শুভদা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’। প্রায় ২৫টি ছবি নির্মাণ ও পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০১১ সালে এই পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। রাজ্জাক স্বাধীনতা পদকেও ভূষিত হন। তার সর্বশেষ অভিনীত ছবি ‘কার্তুজ’ ২০১৪ সালে মুক্তি পায়। আর সর্বশেষ নির্মিত ছবি ‘আয়না কাহিনী’ ২০১৩ সালে মুক্তি পায়। জাতিসংঘ তাকে নারীদের জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশের শুভেচ্ছাদূত নিযুক্ত করে। ছেলে সম্রাট জানান, নায়করাজ গতকাল সকাল থেকেও বেশ সুস্থ ছিলেন। নির্মিতব্য একটি টেলিফিল্মে অভিনয়ের কথাও চলছিল তার। তা ছাড়া নায়করাজ গত সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এ বছরই নারী নির্যাতনের বিষয় নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেবেন তিনি। কিন্তু সব কিছু মিথ্যা করে দিয়ে গতকাল আকস্মিকভাবে চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। রেখে যান তার অনবদ্য সব সৃষ্টিকর্ম।

হাসপাতালে শোকার্ত মানুষের ঢল : নায়করাজের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। এ সময় একে একে অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ আসতে দেখা যায়। প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখতে সেখানে যান আশরাফুজ্জামান উজ্জল, আলমগীর, গাজী মাযহারুল আনোয়ার, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেরদৌস প্রমুখ। মহানায়কের মৃত্যুর খবর শুনে ইউনাইটেড হাসপাতালের গেটে ভিড় করেন সাধারণ ভক্তরা।

সমাজের সর্বস্তরের শোক : নায়করাজের মৃত্যুতে সর্বস্তরের মানুষ শোক জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রমুখ। এ ছাড়ও শোক জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমির ফয়সাল, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর