বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

চাঁদাবাজির রাজ্য বুড়িমারী বন্দর

ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চাঁদাবাজির রাজ্য বুড়িমারী বন্দর

রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই চলে চাঁদাবাজি। পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যত জায়গায় যেতে হয় তার সব ক্ষেত্রেই দিতে হয় চাঁদা। চাঁদা না দিলে আটকে থাকে পণ্য। ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে চাঁদা দিয়েই মালামাল ছাড়িয়ে নেন। দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বুড়িমারী স্থলবন্দরে এই ভয়াবহ চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা ওই বন্দরকে এখন চাঁদাবাজির রাজ্য বলেই আখ্যায়িত করেন। এই চাঁদাবাজির রাজ্যের আয়তন বুড়িমারী স্থলবন্দর ও বন্দরের বাইরে (জিরো পয়েন্ট থেকে ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত) বিস্তৃত।

চাঁদাবাজিতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস, থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ এমনকি শ্রমিক ইউনিয়ন ও দালালদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। আর চাঁদাবাজির একটি সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে নাম রয়েছে স্থানীয় এমপি (লালমনিরহাট-১) মোতাহার হোসেনের।

বুড়িমারী স্থলবন্দরের ভয়াবহ এই চাঁদাবাজির গোপনীয় একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসেছে। ওই কার্যালয়ের যুগ্মসচিব ফরিদ আহাম্মদ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গৃহীত কার্যক্রমের ফলাফল জানানোর নির্দেশনাক্রমে অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই পত্রটির স্মারক নম্বর ০৩.০৭৯.০১৬.২৩.০০.০১.২০১৬.১২৭ (৫)। ৮ ফেব্রুয়ারি চিঠিটি পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্ত্তী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক নাম এসেছে। এখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পুলিশ, বন্দর কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতাদের নাম রয়েছে। এর মধ্যে যারা আমাদের আওতায় (স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ) তাদের বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। অন্যদের বিষয়ে স্ব স্ব ডিপার্টমেন্ট তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পণ্য আমদানি-রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে বুড়িমারী স্থলবন্দর। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম এ স্থলবন্দর দিয়ে পাথর, ফল, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ফলে এ ধরনের একটি বন্দরে চাঁদাবাজির কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো গোপনীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

চাঁদাবাজির চিত্র : জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০টি পাথরবাহী এবং ৬০-৭০টি ফলবাহী ট্রাক ছাড়াও অন্যান্য পণ্যবাহী ট্রাক বুড়িমারী স্থলবন্দরে যাতায়াত করে। একটি সংগঠিত চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট বন্দর কর্তৃপক্ষ, উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ অফিস, কাস্টমস, দালাল অফিস, লেবার হ্যান্ডলিং ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন, হাইওয়ে পুলিশ ও পাটগ্রাম থানা পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/সংস্থার নামে যাতায়াতকারী ট্রাকে চাঁদাবাজি করে অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। দিনের আলোর পাশাপাশি সন্ধ্যার পরও ওই চাঁদাবাজি অব্যাহত থাকে।

ফলবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজির হার : কাস্টমস অফিস ২ হাজার টাকা (প্রতি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে), উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ অফিস-২০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), থানা পুলিশ ৪০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), হাইওয়ে পুলিশ ২০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), কাস্টমস নিরাপত্তা প্রহরী ১০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), বন্দর নিরাপত্তা প্রহরী ৫০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), এসবি পুলিশ ২০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), লেবার অ্যাসোসিয়েশন ১ হাজার টাকা ((ট্রাকপ্রতি), দালাল অফিস ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), ট্রাক টার্মিনাল (বাবুল গ্রুপ) ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি), জিরো পয়েন্ট (বাবুল গ্রুপ) ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা (ট্রাকপ্রতি)। পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়াও পাথরবাহী ট্রাকের জন্য ঘাটে ঘাটে চাঁদার পৃথক হার রয়েছে।

চাঁদাবাজিতে জড়িত যেসব কর্মকর্তা : চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বুড়িমারী স্থলবন্দরের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম, উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক মো. আবদুল কাদের, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সহকারী কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইমিগ্রেশন) মো. আনোয়ার হোসেন, ভারপ্রাপ্ত ও তদন্ত কর্মকর্তা (পাটগ্রাম থানা) পরিদর্শক অবনি শঙ্কর, পরিদর্শক মো. মাহফুজ আলম ও হাইওয়ে পুলিশ পরিদর্শক প্রসূন কুমারের নাম এসেছে প্রতিবেদনে।

সংগঠিত সিন্ডিকেট : প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী বুড়িমারী স্থলবন্দরের চাঁদাবাজির বিষয়টি মূলত দুটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট স্থলবন্দরকেন্দ্রিক চাঁদাবাজিতে জড়িত রয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মোতাহার হোসেন এমপির পক্ষে মো. তাহাজ্জুল ইসলাম মিঠু, সভাপতি বুড়িমারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগসহ কয়েকজন ব্যক্তি চাঁদা আদায় করে থাকেন।’ এই গ্রুপটির বাইরে স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্মিলিত আরেকটি গ্রুপও চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বুড়িমারী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মো. নাহিদ, ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. মুছা, বুড়িমারী ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা বকুল মিয়া প্রমুখের নাম রয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া বুড়িমারী ট্রাক শাখার সভাপতি (দালাল অফিস নিয়ন্ত্রণকারী) মো. আওলাদ হোসেন (সরদার), লেবার ইউনিয়নের সভাপতি মো. সফর উদ্দীন, সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, সদস্য ফজলু, মান্নান প্রমুখও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনের সঙ্গে গত রাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এসে মন্তব্য নিতে হবে, মোবাইলে আমি মন্তব্য করব না।’

সর্বশেষ খবর