শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
চকবাজার ট্র্যাজেডি

গুদাম যাচ্ছে শ্যামপুর-টঙ্গীতে

বিশেষজ্ঞদের পরিদর্শন, চুড়িহাট্টায় এখনো আতঙ্ক হাসপাতাল থেকে তিনজনকে ছাড়পত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

গুদাম যাচ্ছে শ্যামপুর-টঙ্গীতে

চুড়িহাট্টার অগ্নিদগ্ধ ভবনগুলো এখনো মূর্তিমান আতঙ্ক। ছড়াচ্ছে পোড়া গন্ধ। সর্বত্র আগুনের দাগ। এলাকাটি ঘিরে রাখা হয়েছে। নেই কোনো কর্মচাঞ্চল্য। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সাক্ষী এসব ভবন দেখার জন্য প্রতিদিনই ভিড় করছে উৎসুক মানুষ।

দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানান, আজ পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণের অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এখানকার বিভিন্ন ভবনে রাখা কেমিক্যাল অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য রাজধানীর শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এদিকে গতকাল আগুনে পোড়া ভবন পরিদর্শনের যায় বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল। এ ছাড়া দুপুরে আতঙ্ক আর মানসিক আঘাত (ট্রমা) নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে বাড়ি ফিরেছেন অগ্নিকান্ডে  দগ্ধ তিনজন।

গতকাল সকালে ঘটনার পাঁচ দিন পর পুড়ে যাওয়া চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশন পরিদর্শন করেন অধ্যাপক ড. ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে বুয়েট শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল। এ সময় তারা ভবনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। পরে তারা উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় ড. ইশতিয়াক আহমেদ জানান, পুড়ে যাওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনে আরও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে অন্য ভবনগুলো সংস্কার করে ব্যবহার করা সম্ভব। তিনি বলেন, আগুনের উৎস সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন কমিটি কাজ করছে। কেমিক্যাল অবশ্যই একটা উৎস। একেকজন একেকভাবে ফুটেজের বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরাও নানা কথা বলছেন। একক কোনো কিছু এখনো শিওর না। তবে কেমিক্যালের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যে বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুপুরে চুড়িহাট্টায় আগুনে দগ্ধ তিনজনকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তারা হলেন রিকশাচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (৪৫), মোজাফফর হোসেন (৩২) ও ট্রলিচালক হেলাল সিকদার (১৮)। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক নোয়াজেশ খান জানান, ছাড়পত্র দেওয়া হলেও তারা চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। দগ্ধ বাকি চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা একটু আশঙ্কাজনক। আতঙ্ক আর মানসিক আঘাত শুধু দগ্ধ এই তিনজনের মধ্যেই নেই; আতঙ্ক এখনো তাড়া করছে আগুনের লেলিহান শিখার আক্রমণের প্রত্যক্ষদর্শীদেরও। ঘটনাস্থলে পুড়ে যাওয়া টয়োটা প্রাইভেট কারের চালক-মালিক ও পিকআপের চালক দুদু মিয়ার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। প্রাইভেট কারের চালক আর মালিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। চালক ইউসুফ আলী ওইদিনের ঘটনার বর্ণনায় জানান, তারা শান্তিনগর থেকে চুড়িহাট্টা মসজিদের পাশের বাসায় ফিরছিলেন। তখন আনুমানিক ১০টা ২৫ মিনিট। ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে যানজটে আটকা পড়েন তারা। দরজা-জানালা বন্ধ গাড়ির ভিতরে হঠাৎ বিকট শব্দ তাদের কানে পৌঁছে। মুহূর্তে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। তখন তাদের মনে হাচ্ছিল যুদ্ধের দামামার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটছে। জীবন বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করা শুরু করে মানুষ। তিনি যেভাবে ছিলেন সে অবস্থায় গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত আজগর লেনের দিকে দৌড়াতে থাকেন। পায়ের জুতা গাড়ির মধ্যে থাকায় ভাঙা কাচে তার দুই পা কেটে যায়। পরদিন তার বাসার লোকজন তাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান।

প্রাইভেট কারের মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি ড্রাইভারের বাম পাশের সিটেই বসা ছিলাম। কিছু দূর পরই ছিল আমার বাসা। যানজটের কারণে তখন আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মনে হলো বিকট শব্দে আগুনের একটি বড় শিখা আমাদের গাড়িতে এসে পড়ল। ড্রাইভার আমাকে বলল, ভাই দ্রুত বের হন। গাড়ির সব দরজা অটো লক করা ছিল। তখন আমি ড্রাইভারের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেদিকে ফাঁকা পাই সেদিকেই পালিয়ে যাই। রাত ১টার দিকে বাসার কাছে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এখনো চোখের মধ্যে কোনো আলো কিংবা সামান্য শব্দে আমার ভিতরটা আঁতকে ওঠে। আমার জীবনের এত বছরেও এত বিকট শব্দ কখনো শুনিনি। যখন গাড়ি থেকে বেরিয়ে পালাচ্ছিলাম, তখন পাশের কমিউনিটি সেন্টার থেকে একটি বিয়েবাড়ির গাড়ি আসছিল। ঘটনার সময় গাড়ির ভিতরে পাঁচজন পুরুষ ও দুজন নারীকে দেখা গিয়েছিল। পরে তাদের অবস্থা সম্পর্কে আমি আর জানতে পারিনি।’

দুদু মিয়া জানান, ‘চোখের পলকেই সবখানে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। আগুন দেখেই রাজমহলে বসা অবস্থায় পরোটা না খেয়েই পালিয়ে বাঁচি আমরা। সাভার থেকে ওয়াহিদ ম্যানশনে যে দোকানে আমরা মাল আনতে গিয়েছিলাম সেই দোকানের মালিক নীরব ঘটনার দিনই মারা যান।’

গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, চুড়িহাট্টা মসজিদ মোড়ে যুক্ত থাকা চারটি সড়কেই উৎসুক মানুষের ভিড়। সড়কগুলোয় ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন জানান, ‘আগুনের ভয়াবহতা আর অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর জেনেছি। পাশেই আমাদের আত্মীয়স্বজনরা থাকেন। তাদের খোঁজ নিতে এসে আগুন লাগা স্থানটি একটু দেখতে এসেছি।’

আজ অভিযান : সকাল সাড়ে ১০টায় পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন অপসারণে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করবে ডিএসসিসি গঠিত টাস্কফোর্স। লালবাগের ইসলামবাগে এ অভিযান শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। এর আগে আবাসিক ভবন থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিকের গুদাম সরানোর জন্য মাইকিং করা হয়েছে। চানখাঁরপুল, বকশীবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, বাবুবাজার, বংশালে রিকশায় করে মাইকিং করা হয়। গুদাম ও মজুদ সরানো না হলে বিশেষ অভিযানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

শ্যামপুর, টঙ্গীর সরকারি গুদামে রাখা হবে কেমিক্যাল : গতকাল শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন ভবনে রাখা কেমিক্যাল অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য রাজধানীর শ্যামপুর ও টঙ্গীতে নিরাপদ স্থানে সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী, স্থায়ী পল্লী স্থাপনের আগে এসব জায়গায় থাকবে সব কেমিক্যাল পণ্য। শ্যামপুরে অবস্থিত বিসিআইসির উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায় বিএসইসির খালি জায়গায় এগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে দুটি স্থান মিলিয়ে ১২.১৭ একর জমির ওপর ৪ লাখ বর্গফুট আয়তনের স্টিল শেড নির্মাণ করে এগুলো সংরক্ষণ করা হবে। শিল্পসচিব মো. আবদুল হালিমের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. সাহিদুর রহমান পরাগ ও বাংলাদেশ অ্যাসিড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ পলাশ।

উল্লেখ্য, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সর্বশেষ খবর