মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

রক্তাক্ত কলম্বো এখন শোকস্তব্ধ

সিরিজ বোমায় নিহত ২৯০, আহত ৫০০, গির্জা পাঁচ তারকা হোটেল কিছুই রেহাই পায়নি, আটক ২৪, সন্দেহে জঙ্গি গোষ্ঠী, শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রক্তাক্ত কলম্বো এখন শোকস্তব্ধ

ধ্বংসস্তূপে পরিণত কলম্বোর সেন্ট অ্যান্টনি গির্জা। হামলার পর সতর্ক প্রহরায় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা। আতঙ্কে শ্রীলঙ্কা ছাড়ছেন বিদেশিরা -এএফপি

রবিবার সকালে একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে শ্রীলঙ্কার তিনটি গির্জা ও তিনটি অভিজাত হোটেল। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলা ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। মোট আট জায়গায় আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন ২৯০ জন। এর মধ্যে এক বাংলাদেশিসহ বিদেশি নাগরিক রয়েছেন ২৭ জন। মূলত ইস্টার সানডের প্রার্থনায় সমবেত হওয়া হাজারো মানুষই হামলার শিকার হন। শ্রীলঙ্কার এসব হামলায় জড়িত সন্দেহে ২৪ শ্রীলঙ্কান নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার উগ্রপন্থি মুসলমানদের ন্যাশনাল তাওহিদ জামায়াত নামের সংগঠনকে। তবে তদন্ত ও গ্রেফতারাভিযানের স্বার্থে গতকাল (সোমবার দিবাগত) মধ্যরাত থেকে শোকে স্তব্ধ শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। জানা যায়, রবিবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে একযোগে বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর শাংরি লা হোটেল, কোতাহেনা কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চ, নেগাম্বোর কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ান ক্যাথলিক চার্চ ও কলম্বোর কিংসবুরি হোটেলে। এর পাঁচ মিনিট পর সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে কলম্বোর সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলের রেস্তোরাঁয় হয় বোমা বিস্ফোরণ। বাত্তিকালোয়ার জিয়ন রোমান ক্যাথলিক চার্চে বিস্ফোরণ হয় সকাল ৯টা ০৫ মিনিটে। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে আবারও হয় বোমা বিস্ফোরণ। দেহিওয়ালার জাতীয় চিড়িয়াখানার কাছে নিউ ট্রপিকাল ইন হোটেলে হয় দিনের সপ্তম বোমা বিস্ফোরণ। দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে কলম্বোর দিমাটাগোদায় একটি বাড়িতে পুলিশি অভিযান চলার সময় হয় আরও একটি বিস্ফোরণ। দিনের অষ্টম এই বিস্ফোরণে তিন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। এসব হামলার ঘটনায় আহত হয়েছেন সাড়ে চারশ মানুষ। শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ২৭ জন বিদেশি নাগরিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন তুর্কি, একজন ডাচ ও একজন চীনা নাগরিক। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি জায়ান চৌধুরীও (৮) বিস্ফোরণে মারা গেছে। জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্স এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে একটি হোটেলে উঠেছিলেন তারা।

বিবিসি জানিয়েছে, ‘যিশুর পুনরুত্থান’ দিবস উদ্্যাপনে গির্জাগুলোতে তখন চলছিল বিশেষ প্রার্থনা। এর মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে নির্মিত কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এ ছাড়া কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ এবং বাত্তিকালোয়ার জিয়ন গির্জাও শ্রীলঙ্কায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাসনালয়। বিস্ফোরণে প্রতিটি গির্জাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছাদ উড়ে যায়। বিধ্বস্ত গির্জাগুলোর বেঞ্চ আর যিশুর ভাস্কর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে। অন্যদিকে বিস্ফোরণ হওয়া কলম্বোর শাংরি লা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবুরি হোটেলে তখন সকালের নাস্তা সারতে আসা পর্যটকদের ভিড় ছিল। আর সেই পর্যটকরাই ছিলেন আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট।

গত বছর একটি বৌদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে শ্রীলঙ্কার উগ্রপন্থি মুসলিমদের সংগঠন ন্যাশনাল তাওহিদ জামায়াতের নাম খবরে এসেছিল। শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুজুথ জয়সুন্দর ১১ এপ্রিল দেশটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি দল ন্যাশনাল তাওহিদ জামায়াত (এনটিজে) কলম্বোয় ভারতীয় হাইকমিশন ও শ্রীলঙ্কার প্রধান গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু পুলিশপ্রধানের ওই সতর্কবার্তা পুরোপুরি আমলে না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, ‘আমাদের এ বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার মতো সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি।’ তিনি বলেন, একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন এ ঘটনার পেছনে ছিল বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন। শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রাভন বিজয়বর্ধনে বলছেন, ‘হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। একটি গোষ্ঠীই হামলাগুলো চালিয়েছে। কোনো উগ্রপন্থি দল এ দেশে থাকতে পারবে না। তাদের তৎপরতা বন্ধের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই আমরা নেব।’ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এ হামলার কঠোর নিন্দা প্রকাশ করে নাগরিকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এ হামলাকে ‘অত্যন্ত নিষ্ঠুর সহিংসতা’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি ‘হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা’ প্রকাশ করেছেন তিনি।

কেন ইস্টার সানডেতে হামলা : শ্রীলঙ্কায় সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে সিকি শতাব্দী ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। এরপর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপদেশ হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় গন্তব্য। শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিদের মধ্যে ১৩ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলমান, আর ৭ শতাংশ খ্রিস্টান। ইস্টার সানডেতে খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো থাকে জমজমাট। এ সময়টায় পর্যটকরাও ছুটি কাটাতে আসেন। হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি নিশ্চিত করার জন্যই ইস্টার সানডে এবং গির্জা ও হোটেলগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এথিরাজন আনবারাসন।

সোমবার মধ্যরাত থেকে শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা : একযোগে বোমা হামলায় ২৯০ জনের মৃত্যুর পর শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের মিডিয়া ইউনিট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তেই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জরুরি অবস্থা জারির এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না। এদিকে রাজধানী কলম্বোতে টানা দ্বিতীয় রাতের মতো কারফিউ জারি করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। গতকাল রাত ৮টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত এই কারফিউ বলবৎ ছিল। রবিবার সকাল ও দুপুরে দুই দফায় তিনটি গির্জা ও চারটি হোটেলসহ আট জায়গায় ওই বোমা হামলার পর শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত ২৪ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। ভয়াবহ এ হামলার পরও কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু রাতভর কারফিউ জারি থাকায় বহু লোক বিমানবন্দরে আটকা পড়ে। গতকাল সকালে কারফিউ তুলে নেওয়ার পর লোকজন বাড়ির পথ ধরে।

বিমানবন্দরের কাছ থেকে পাইপবোমা উদ্ধার : শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছ থেকে ‘ঘরে তৈরি’ একটি বোমা উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার দেওয়া খবরের বরাতে বিবিসি ও এনডিটিভি জানিয়েছে, রবিবার রাতে বিমানবন্দরের প্রধান টার্মিনালমুখী সড়কে ওই পাইপবোমাটি পাওয়া যায়। পরে বিমান বাহিনী সেটি নিষ্ক্রিয় করে বলে সোমবার জানিয়েছে পুলিশ। শ্রীলঙ্কার বিমান বাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ছয় ফুট লম্বা ওই পাইপ বোমাটি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া কলম্বোর পুলিশ পেত্তায় একটি বাসস্টেশন থেকে ৮৭টি লো এক্সপ্লোসিভ ডেটোনেটর উদ্ধার করেছে।

আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এমন হামলা সম্ভব নয় : সিরিজ বিস্ফোরণের ঘটনায় আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা। কলম্বোয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এমন শঙ্কার কথা জানান দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রজিথা সেনারত্ন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি না যে এই হামলাগুলো শুধু দেশের ভিতরে সীমাবদ্ধ একটি গোষ্ঠী চালিয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এসব হামলা সফল হতে পারত না।’ হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন রজিথা সেনারত্ন। তিনি জানান, মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিহতদের সবার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য এক লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। আহতরাও ক্ষতিপূরণ পাবেন। বোমার আঘাতে জর্জরিত গির্জা মেরামতের জন্য সরকারিভাবে তহবিল দেওয়া হবে। শিগগিরই এটি শুরু হবে বলে জানান তিনি।

শ্রীলঙ্কা হামলায় আইএসের উল্লাস : শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় উল্লাস প্রকাশ করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তারা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার বিলাসবহুল হোটেল ও গির্জায় হামলাকে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে। অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ বলছে, ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে গোলাগুলির প্রতিশোধে শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার প্রশংসা করেছে আইএসের সমর্থকরা। এতে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের যেন আল্লাহ কবুল করে নেন সেই প্রার্থনাও করা হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর