বুধবার, ১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুলিশের ওপর হামলায় কারা

তিন কারণ সামনে রেখে তদন্ত
বছিলায় জঙ্গি আস্তানার ঘটনায় মামলা

সাখাওয়াত কাওসার

তিন কারণ সামনে রেখে রাজধানীর গুলিস্তানে পুলিশ বক্সের পাশে বিস্ফোরণের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। গত সোমবার সন্ধ্যায় নিক্ষেপিত বিস্ফোরক আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) হলেও নিক্ষেপকারীরা সরাসরি পুলিশকে টার্গেট না করায় তা জঙ্গিদের হামলা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একইসঙ্গে উচ্ছেদ নিয়ে হকার-পুলিশ দ্বন্দ্ব কিংবা ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালাতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হতে পারে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গতকাল একটি মামলা করেছে পল্টন থানায়। অন্যদিকে, সোমবার  মোহাম্মদপুরের বছিলা মেট্রো হাউজিং এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গতকাল সকালে র‌্যাব-২ বছিলা ক্যাম্পের ডিএডি  মোহাম্মদ আবদুলাহ বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এই মামলা করেন বলে নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জি জি বিশ্বাস।

দুই ট্রাফিক কনস্টেবল ও এক কমিউনিটি পুলিশ সদস্য আহতের ঘটনায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওবায়দুর রহমান বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩/৬ ধারায় এ মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৫৩। মামলায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে র অভিযোগ আনা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সোমবার সন্ধ্যায় গুলিস্তানে পুলিশ বক্সের কাছে হামলার পাঁচ ঘণ্টা পর এক টুইট বার্তায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) সদস্যরা দায় স্বীকার করলেও তাকে আমলে নিতে চাচ্ছে না পুলিশ। তারা বলছেন, পুলিশকে টার্গেট করে হামলা হলে তা সরাসরি পুলিশের ওপরই ফেলা হতো। তবে সাধারণত জঙ্গিরাই হামলার ক্ষেত্রে ‘আইইডি’ (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ব্যবহার করে। তবে গুলিস্তান এলাকায় উচ্ছেদ নিয়ে পুলিশ-হকারদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এখানে পুলিশকে নিবৃত্ত রাখার জন্যই পুলিশ বক্সের পাশে হামলা করেও থাকতে পারে একটি চক্র। এ ছাড়া ছিনতাই কিংবা ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটিয়ে কোনো অপরাধী দ্রুত পালিয়ে যেতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতেও এ ধরনের হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকতে পারে।

গতকালও দ্বিতীয় দিনের মতো ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলামের নেৃতত্বে বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্য সংবলিত একটি বিশেষায়িত দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এর বাইরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। এরই মধ্যে তারা বিশ্লেষণাত্মক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, হামলাকারী কারা তা নিশ্চিত হতে কাজ চলছে। বিভিন্ন এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন বিশ্লেষণ চলছে। বিস্ফোরক কী আগে থেকেই সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল? নাকি ওই সময়ই ছুড়ে মারা হয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে বিস্ফোরক যে আইইডি তা নিশ্চিত। 

এদিকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আহতদেও দেখতে গিয়ে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) ককটেল নিক্ষেপ করেছে বলে দাবি সাইট ইন্টেলিজেন্সের। তবে উগ্রবাদ ইস্যুকে কেন্দ্র কওে কোনো মহল উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এ কাজ করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর তাদের (জঙ্গি) বিধ্বস্ত করা হয়েছে। কখনো কখনো তারা বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর অপচেষ্টা করছে, সেগুলো আমরা নজরদারিতে রাখছি। এ ঘটনার পর ট্রাফিক পুলিশদের নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজ চলছে।

এদিকে, মোহাম্মদপুরের বছিলা মেট্রো হাউজিং এলাকায় জঙ্গি আস্তানা নিয়ে আটক চারজনের মধ্যে বাড়ির কেয়ারটেকার সোহাগের স্ত্রী মৌসুমীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকিদের এখনো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব হেফাজতে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করেই বাড়ির মালিক ওয়াহেদ মিয়া ডিস ব্যবসার অফিস বাদ দিয়ে মসজিদ এবং হাফিজিয়া মাদ্রাসা স্থাপনকে খতিয়ে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তিনি নিজ উদ্যোগেই এমনটি করেছেন নাকি জঙ্গিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমনটা করেছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিহত দুই জঙ্গির লাশের খি ত অংশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের খোঁজ নেয়নি কেউ। অন্যদিকে, ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে পুলিশের গাফিলতির প্রশ্ন উঠেছে।

র‌্যাব জানায়, বছিলায় জঙ্গি ঘাঁটিতে যে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে তা অনেক শক্তিশালী ছিল। তারা এসব বোমা কোথায় পেল তাই জানার বিষয়। তাদের আস্তানায় থাকা বোমাগুলো শক্তিশালী হওয়ায় দুই জঙ্গির শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে দুজনের তিনটি পা আলাদা পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে একটির মাথা অক্ষত আর আরেকটির একাংশ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাদের শরীরের অন্যান্য অংশ টুকরো টুকরো হয়ে বাড়িটিতে ছড়িয়ে ছিল বলে জানিয়েছে কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী।

গতকাল সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকার বাসিন্দাদের চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ। র‌্যাব-২ সদর দফতরের এত কাছাকাছি এমন একটি স্থানে সবার চোখের আড়ালে এমন আস্তানা হবে তারা তা কখনো কল্পনাও করতে পারেননি। স্থানীয় ফারজানা আক্তারের বাসা ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১০০ মিটার। তিনি এ প্রতিবেদককে বলছিলেন, আমরা এখানে বসবাস করছি প্রায় দুই বছর ধরে। সোহাগ আগে ডিসের টাকা উঠানোর সঙ্গে গরুর খামারের ব্যবসা করত। হঠাৎ করেই তিনি খামার বাদ দিয়ে দেন। তবে নিহত দুই যুবককে তিনি কখনো দেখেননি বলে জানান। ওই এলাকারই বাসিন্দা জুনায়েদ আহমদ বলেন, ভাই আমরা গরিব মানুষ। সকালে বের হই, রাতে ফিরি। তবে ছুটির দিনে এলাকায় থাকি। তবে আমাদের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এমন আস্তানা এলাকায় এই কথা ভাবতেও গা শিউরে উঠছে।

র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, জেএমবির একটি সক্রিয় গ্রুপ নাশকতার পরিকল্পনা করে বোমা, বিস্ফোরক ও অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করেছিল এমন খবরের ভিত্তিতে আমরা সেখানে অভিযান চালাই। স্থানীয়দের অনেকেই তাদের দেখলেও ধারণা করতে পারেনি যে, তারা জঙ্গি দলের সদস্য ছিল। দুই জঙ্গির প্রকৃত পরিচয় জানতে কাজ করা হচ্ছে।

ভাড়াটিয়াদের তথ্যের বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার বছিলা বিট পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই নয়ন মিয়া বলেন, থানার জটিলতার কারণে গত এক বছর ধরে এই এলাকার ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। সেই সঙ্গে হাজারীবাগ থানা পুলিশও কখনো ওই এলাকার ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করেনি।

বিস্ফোরিত ককটেলটি মোটেই সাধারণ ছিল না- ডিএমপি কমিশনার : ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, রাজধানীর গুলিস্তানে পুলিশের ওপর বিস্ফোরিত ককটেলটি মোটেই সাধারণ ছিল না। এটি বেশ শক্তিশালী ছিল। আর ওই ককটেল বিস্ফোরণে তিন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব বলেন তিনি।

সোমবার রাত পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তানের ডন প্লাজার সামনে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে একটি ককটেল ছোড়া হয়। এতে ট্রাফিক কনস্টেবল নজরুল ইসলাম (৩৭) ও লিটন (৪২) এবং কমিউনিটি পুলিশ আশিক (২৮) আহত হন। তাদের চিকিৎসার সার্বিক খোঁজ নেওয়ার পর ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। আইএস যে দাবি করেছে তা তাদেরই কিনা বা অন্য কেউ প্রতারণামূলকভাবে এ ধরনের পোস্ট দিয়েছে কিনা, তা আমাদের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অ্যান্টি-টেররিজম বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখছেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর