মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভূমধ্যসাগরে মৃত ২৭ বাংলাদেশিকে শনাক্ত

প্রতিদিন ডেস্ক

তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে নিহতদের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশির লাশ শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।

রেড ক্রিসেন্টের পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন বিভাগের  প্রোগ্রাম অফিসার সাইয়েদা আবিদা ফারহীন গণমাধ্যমকে গতকাল জানান, নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ধারণার চেয়েও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সংঘাতময় লিবিয়ার জুয়ারা  থেকে অবৈধভাবে ইতালিতে যেতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রওনা হয়েছিলেন ওই নৌ যাত্রীরা। ভোররাতে তিউনিসিয়া উপকূলে আরেকটি ছোট নৌকায় তাদের ওঠানোর পর যাত্রীর ভারে তা ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার জেলেরা সাগর থেকে ১৬ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন, তাদের মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশি। ফারহীন জানান, চারজন বাংলাদেশি এখন তিউনিসিয়ার জারজিস শহরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তারা ওই ১৪ জনের মধ্যে কিনা-  সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। 

সিলেটে অভিযান : সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, নগরীর জিন্দাবাজার ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড শপিং সিটির ৫ম তলায় উঠলেই চোখে পড়ে ‘ইউসিএস এডুকেশন’র সাইনবোর্ড। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে স্টুডেন্ট ও ভিজিট ভিসা পাইয়ে দেওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশে লোক পাঠানোর জন্য বিভিন্নজনের সঙ্গে রীতিমতো চুক্তিও সম্পাদন করছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির বিদেশে লোক পাঠানোর কোনো বৈধতাই নেই। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই শুরু করেছে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা। গতকাল জেলা প্রশাসনের অভিযানে মানব পাচারের এমন গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বিদেশে লোক পাঠাতে সরকারের কাছ থেকে যে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয় তা জানেনই না ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিরা মিয়া। অথচ নিজেই দাবি করছেন তিনি স্টুডেন্ট ও ভিজিট ভিসার কাজ করছেন। বৈধ কাগজ দেখাতে না পারায় হিরা মিয়াকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদ  ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নির্বাহী হাকিম হেলাল চৌধুরী।

জানা গেছে, শুধু ইউসিএস এডুকেশন নয়, অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট বাংলাদেশের (আটাব) হিসাব অনুযায়ী সিলেটে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এরকম প্রায় তিনশ ট্রাভেলস। যারা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে বিদেশ মানুষ পাঠিয়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদেশ যাওয়ার পথে প্রাণহানি ঘটে অনেকেরই। এসব অবৈধ ট্রাভেলস ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছিল আটাব। কিন্তু তা আমলেই নেয়নি প্রশাসন। গত ১৬ এপ্রিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলাল চৌধুরীকে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত অবৈধ ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লিখিত নির্দেশ দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাছির উল্লাহ খান। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে শুরু হয়নি অভিযান। গত বৃহস্পতিবার ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে সিলেটের ৭ তরুণের প্রাণহানির ঘটনার পর টনক নড়ে জেলা প্রশাসনের। অবশেষে গতকাল সিলেট নগরীতে পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পাঁচটি টিম অভিযানে নামে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। অভিযানকালে নগরীর তালতলা, জিন্দাবাজার ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড শপিং সিটি, রাজা ম্যানশন ও রোজভিউ কমপ্লেক্সের বিভিন্ন অবৈধ ট্রাভেলসের ২০ মানব পাচারকারীকে এক থেকে পাঁচ মাস বিনাশ্রম কারাদ- ও ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়। অভিযান টের পেয়ে এ সময় অনেক অবৈধ ট্রাভেলস ব্যবসায়ী তাদের অফিসে তালা দিয়ে পালিয়ে যান।

শরীয়তপুরে মাতম : শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী নৌকা ডুবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চার যুবক রয়েছে। তাদের সন্ধান না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা বিচলিত হয়ে পড়েছেন। প্রত্যেক পরিবারে চলছে মাতম। নিখোঁজ ওই চার যুবক হলেন নড়িয়া উপজেলার ভূমখাড়া ইউনিয়নের পাটদল গ্রামের মৃত হাসেম মোল্লার ছেলে সুমন মোল্লা (২৬), দক্ষিণ চাকধ গ্রামের গৌতম দাসের ছেলে উত্তম দাস (২৩), হারুন হাওলাদারের ছেলে জুম্মান হাওলাদার (১৯) ও চাকধ গ্রামের মোর্শেদ আলী মৃধার ছেলে পারভেজ মৃধা (২২)। ওই নৌকায় থাকা দক্ষিণ চাকধ গ্রামের আলাউদ্দিন মকদমের ছেলে শিশির মকদম (২২) ও শিশিরের মামা নলতা গ্রামের মিন্টু মিয়া (৩০) তিউনিসিয়ার একটি আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন। যুবকরা গত বছর রমজানের সময় স্থানীয় মানব পাচারকারী সদস্য কেদারপুর গ্রামের আক্কাছ মাদবরের সঙ্গে লিবিয়া যান। নিখোঁজ দক্ষিণ চাকধ গ্রামের জুম্মান হাওলাদারের বাবা হারুন হাওলাদার বলেন, ‘জমি বিক্রি করে গত রমজানে দালাল আক্কাছ মাদবরের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দেই। এক মাসের মধ্যে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা। এরপর লিবিয়া থেকে ছেলে মাঝে মাঝে ফোন করে জানাত- দালালরা ওদের নির্যাতন করত। পুনরায় আবার আড়াই লাখ টাকা পাঠাইছি। এখন আমার ছেলেটাই সাগরে ডুবে গেল।’

বিচার চায় হবিগঞ্জের দুই পরিবার : এদিকে হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে দুই যুবক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লোকড়া গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গতকাল শত শত লোক ভিড় জমান মোক্তাদির হোসেন ও আবদুল কাইয়ুমের বাড়িতে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও চেম্বার প্রেসিডেন্ট মোতাচ্ছিরুল ইসলাম এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন রুবেল দুপুরে দুই বাড়িতে যান এবং স্বজনদের সান্ত্বনা দেন।

নিখোঁজ মোক্তাদিরের বাবা কৃষক আবদুল জলিল জানান, তার ছেলে কলেজে লেখাপড়া করে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে চাকরি করত। তিনি বলেন, ‘ভালোই চলত তার পরিবার। কিন্তু বানিয়াচং উপজেলার ইয়ালা গ্রামের দালাল মোফাচ্ছির মিয়া ও ঢাকার দালাল রহমত মিয়া আমার ছেলেকে লোভ দেখায়। তারপর ছেলের দাবি মেটাতে আমি জমিজমা বিক্রি করে তাকে বিদেশে পাঠাই।’ তিনি দালালদের শাস্তি দাবি করেন। নিখোঁজ অপর যুবক আবদুল কাইয়ুমের বাবা হাজী আলাউদ্দিনের পরিবারের লোকজনও হতবিহ্বল। হাজী আলাউদ্দিন জানান, দালাল মোফাচ্ছির ও রহমত মিয়ার জন্য তার সর্বনাশ হয়েছে। এখন তার ছেলেও গেল, সম্পদও গেল। দালাল মোফাচ্ছির ও রহমতের বিচার চান তিনি।

 

সর্বশেষ খবর