শনিবার, ১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

আবেদন করলেই মেলে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স

আনিস রহমান

আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি সাধারণভাবে নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তার উল্টো। আবেদন করলেই পাওয়া যায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স। লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও মানা হয় না কখনো কখনো। গুরুত্ব পাচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনা। আবার ঘাটে ঘাটে টাকা খরচ করে সহজেই মালিক    হওয়া যায় বৈধ অস্ত্রের। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পেশাদার অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করে অস্ত্রের লাইসেন্স নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার অস্ত্র ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করছেন দিনের পর দিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে বশে এনে তারা এ কাজ করছেন। পুলিশ ও র‌্যাবে দায়িত্বরত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই আবার বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স দেখিয়ে অস্ত্র কিনে সেই অস্ত্র ভাড়ায় খাটাচ্ছে বিভিন্ন পেশাদার সন্ত্রাসী ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের কাছে। লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অনুযায়ী ৩০ বছর না হওয়ায় কেউ কেউ অবৈধ অস্ত্র দিয়ে হাত পাকিয়ে নিচ্ছেন। ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের (উ.) সাবেক এক নেতা তার বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, একসময় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শাহজাহানপুর, মগবাজার ও পুরান ঢাকায় অবৈধ অস্ত্রের রমরমা অবস্থা থাকলেও এখন তা কমে এসেছে। তবে রামপুরা, বাড্ডা ও কাফরুল এলাকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্র হরহামেশা ব্যবহার করছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের কাছে খবর আছে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মী অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহে রেখেছেন। কিন্তু তাদের আটক করে সেই অস্ত্র জব্দ করা যাচ্ছে না। কারণ একজন অবৈধ অস্ত্রধারীকে আটকের পর অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যে ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করার কথা সে রকম পরিস্থিতি এখন আর নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ এর ভূমিকা ‘গ’-তে উল্লেখ রয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান সাধারণভাবে নিরুৎসাহিত করা হবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান ৩ (খ)-তে বলা হয়েছে, অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে আগ্রহী ব্যক্তির বয়স হতে হবে ৩০-এর ওপরে এবং ৭০-এর নিচে। ‘ব্যক্তি শ্রেণির’ আয়করদাতা হতে হবে। আবেদনকারী কর্তৃক আবেদনের পূর্ববর্তী দুই বছর ও আবেদনের বছর মিলিয়ে প্রতি বছর ন্যূনতম তিন লাখ টাকা কর পরিশোধ থাকলে রিভলবার বা পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একইভাবে শটগানের জন্য ন্যূনতম এক লাখ টাকা (তিন বছর) আয়কর দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এটি মানা হচ্ছে না। জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজ বানিয়ে লাইসেন্সের আবেদন করছেন আনেকেই। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, বৈধ অস্ত্র কিংবা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে অনেকে অন্যের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। তারা বিভিন্ন ব্যক্তির দেহরক্ষী হিসেবে চাকরি করছেন, যা আইননত অপরাধ। যে কোনো ব্যবসায়ী সামান্য কিছু টাকা হলেই লোকসম্মুখে তার অবস্থান জানান দিতে গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করেন। বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য চাকরিচ্যুতি কিংবা অবসরে গেলে তারা অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়ে অন্যের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে বছরের পর বছর চাকরি করে যাচ্ছেন, যা অস্ত্র আইনের পরিপন্থী। সূত্র জানায়, কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির কাজে। অস্ত্রের ভাগ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা ঢুকছে ওইসব অস্ত্রের মালিক নেতাদের পকেটে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) আর্মস এনফোর্সমেন্ট দলের হাতে অবৈধ অস্ত্রসহ পেশাদার তিন অপরাধী গ্রেফতার হওয়ার পর এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় পেশাদার অপরাধী সাইফুল ইসলাম টিটু, মতিন ওরফে মইত্যা ও হাজী আরমান হোসেনকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ২৮ রাউন্ড গুলি ও তিনটি ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়। পরে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পায় তদন্ত কর্মকর্তারা। আর্মস এনফোর্সমেন্ট দলের কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি ও ব্যবসার আড়ালে অনেকেই অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছেন। অনেকে পেশাদার অপরাধীদের কাছে অবৈধ অস্ত্র দিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে ভাড়াও নিচ্ছেন। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদের সময় অস্ত্র উঁচিয়ে গুলির ঘটনায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন এবং ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমানের নাম আলোচনায় আসে। পরে তাদের দুজনকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার ও শাহবাগ থানায় মামলা হয়। মামলাটি এখনো বিচারাধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে সরকারের কাছ থেকে বৈধভাবে অস্ত্র বিক্রির লাইসেন্স নিয়েছিলেন মেসার্স নেত্রকোনা আর্মস কোং এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বাবুল ওরফে মো. বাবুল মিয়া ও রাজশাহীর কে. আহম্মেদ আর্মস কোম্পানির মালিক নজরুল ইসলাম সোহেল। তারা দীর্ঘদিন ধরে বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। গ্রেফতারের সময় তাদের দখল থেকে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদে তারা র‌্যাব ও পুলিশের কাছে স্বীকার করেন তাদের এই অবৈধ অস্ত্রের মূল ক্রেতা পেশাদার সন্ত্রাসী, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনের দস্যুরা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের গ্রাম-গঞ্জেও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি। টাকা হলে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। দেশের স্থল ও নৌপথে সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিনিয়ত আসছে লাখ লাখ টাকার অস্ত্রের চালান। লেবুর বস্তা, শাকসবজি ভর্তি ট্রাক, চালের বস্তা এবং ফলের বক্সে ভর্তি করে, বিভিন্ন ট্রাক, পিকআপ, বাস ও ট্রেনে আসছে অস্ত্রের চালান। কখনো কখনো কুরিয়ার সার্ভিসেও আসছে অবৈধ অস্ত্র। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করলেও বেশির ভাগই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও গড়ে তুলছেন অস্ত্রের মজুদ। চাহিদা মেটাতে দেশের সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত ঢুকছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। সেই সঙ্গে সাগর পথেও অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে।

 

 

সর্বশেষ খবর