শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

জাতির সামনে বিদ্রূপ ও উপহাসের পাত্রে পরিণত খান

পীর হাবিবুর রহমান

জাতির সামনে বিদ্রূপ ও উপহাসের পাত্রে পরিণত খান

তোফায়েল আহমেদ

রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খানের জবানবন্দিতে ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বইসহ বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিয়ে মিথ্যাচারের বিকৃত ইতিহাস তৈরি করে জাতির সামনে উপহাস ও বিদ্রূপের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। নিজে নিজেকে মিথ্যা কথা বলে কীভাবে ছোট করতে হয়, তার নমুনা দেখিয়েছেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান তোফায়েল আহমেদ এ কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ও প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝেছিলেন, এ দেশ বাঙালির অধিকার রক্ষার জন্য নয়, তাই বাঙালি জাতির অধিকার আদায় ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে কলকাতায় বসে তাঁর সমকালীন কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে যে আলোচনা করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি রুমে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর ’৪৯ সালের ২৩ জুন কারাগারে বসেও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনগণের প্রতি গভীর প্রেম ও বিশ্বাস, লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি অবিচল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান যে পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল রাজনীতিবিদ তা তিনি তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করে দিয়ে প্রমাণ করেছেন। জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন প্রায় যৌবনের ১৩টি বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। জেল, জুলুম, ফাঁসি কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেননি। কখন কী বলতে হবে, কখন কী করতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের নেতা বিশ্বরাজনীতিতেই বিরল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁর জনগণকে সঠিক পথ দেখানো ছাড়া কোনো দিন কখনো অসতর্কভাবেও ভুল নির্দেশ দেননি। ’৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী দলের প্রতিষ্ঠাতা হয়েও ন্যাপ গঠন করে দল ছেড়ে দিয়েছেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে কঠোর দমননীতি চালিয়েছেন। দলের ভাঙা-গড়ার মধ্যেও জীবনের কঠিন দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিচল থেকে দেশের ছাত্রসমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে এবং গণমানুষকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত করে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা নিয়ে সারা দেশে একের পর এক জনসভা করে কীভাবে জনপ্রিয় করেছিলেন এবং সেই ৩৫ দিনের সফরে ৩২টি জনসভা ও আটবার গ্রেফতার হওয়ার মধ্য দিয়ে ছয় দফাকে এতটাই তুমুল জনপ্রিয় করেছিলেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান লিখেছিলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ একটি বিপ্লবের জন্য ছয় দফা ঘিরে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা ছাড়া পাকিস্তান সরকারের আর কোনো পথ ছিল না।’ তোফায়েল আহমেদের ভাষায়, ‘ছয় দফা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেনি, জনগণ গ্রহণ করেনি’ বলে সিরাজুল আলম খান তার নিউক্লিয়াস তত্ত্বের যে জিগির করছেন তা বোগাস। তার বইয়ে লেখা ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া সব রাজনৈতিক ঘটনা মিথ্যার আশ্রয়ে লেখা। তিনি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের এমনকি জনগণকে খাটো করেছেন। নিজেকে বড় করতে গিয়ে ইতিহাসের সত্যকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। মিথ্যা দিয়ে যে কেউ বড় হয় না, এ জ্ঞানটুকু তিনি হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের স্থানীয় নেতা বানিয়েছেন। ’৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তে ৭ জুনের হরতাল ঘোষিত হয়েছিল। ৭ জুনের হরতাল পালন করতে শেখ ফজলুল হক মণি অগ্রণী ভূমিকা রাখায় জুলাই মাসে ইকবাল হলের আমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কেউ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে খবর দিলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সিরাজুল আলম খান আমিত্ব জাহির করতে গিয়ে বলেছেন, ৭ জুন হরতালের দিন পুলিশের গাড়িতে করে তাকে পোস্তগোলা শ্রমিকদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আওয়ামী লীগ অফিসে নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে বোঝা যায়, তিনি কী পরিমাণ মিথ্যাচার করেছেন। আর মিথ্যাচার করে না থাকলে যখন সব নেতা জেলে যান, তখন পুলিশ তাকে গাড়িতে করে আনা-নেওয়া করে কোন রহস্যজনক কারণে; এ প্রশ্ন এসে যায়।

আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছিল কারাগারে আটক রেখে, যখন সব রাজনৈতিক নেতা কারাগারে তখন ঊনসত্তরের গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান বঙ্গবন্ধুকে নায়কের বেশে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মুক্ত করেই আনেনি, আইয়ুব খানের পতনই ঘটায়নি, স্বাধীনতার মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল। অথচ তিনি তার লেখায় সেই ইতিহাসকে খাটো করেছেন। তার কোনো ভূমিকা না থাকার পরও নিউক্লিয়াসের তত্ত্ব এনে ইতিহাসের চরম মিথ্যাচারই করেননি, সর্বদলীয় ছাত্রসংগাম পরিষদের সব নেতা ও সংগঠনকে অবমূল্যায়ন করেছেন। ১১ দফা প্রণয়নে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণে এবং সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠনে তার কোনো অবদান ছিল না।

তোফায়েল আহমেদ জানান, ১৪৪ ধারা ভাঙার আসামি তখন তিনি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রাস পাঁচপাত্তু হত্যাকা- ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তাই সময়মতো ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় তিনি ডাকসুর ভিপি ও কারাবন্দী ভুট্টোপন্থি এনএসএফের নাজিম কামরান চৌধুরী ডাকসুর জিএস থেকে যান। তোফায়েল আহমেদ ভোলা গেলে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। এতে তিনি পালিয়ে ’৬৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় চলে আসেন। ’৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ও নাজিম কামরান চৌধুরী আইয়ুব খানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলাভবনের সামনে কালো পতাকা উত্তোলন করে ছাত্র সমাবেশ করেন।

তোফায়েলের ভাষায়, তখন ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী। তাদের একটাই চিন্তা- কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করা যায়। ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ও অন্য গ্রুপের নেতা রাশেদ খান মেনন তখন কারাগারে। তারা এই ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশকে নিয়ে ডাকসু ভবনে বৈঠক করেন। সেদিনের খবরের কাগজে ইতিহাসের সত্যতা এখনো লেখা আছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশ মিলে তিনটি সংগঠন থেকে তিনটি ড্রাফট পেশ করা হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফের লেখার হাত ছিল ভালো। ছাত্রলীগের ড্রাফটি তিনিই তৈরি করেন। ষাটের দশকের ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের নেতারাও কারাগারে। শুধু সিরাজুল আলম খান বাইরে। ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন শামসুদ্দোহা ও সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক। আরেক অংশের নেতা মাহবুব উল্লাহ ও মোস্তফা জামাল হায়দার। পরে এনএসএফ যুক্ত হলে তাদের প্রতিনিধি হন ফখরুল ইসলাম মুন্সী ও ইব্রাহীম খলিল। ১১ দফায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি আনা না গেলেও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও সব রাজবন্দীর মুক্তি চাওয়া হয় এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা জুড়ে দেওয়া হয়। সিরাজুল আলম খান রগরগে মিথ্যাচার করতে গিয়ে বলেছিলেন, ছয় দফার পক্ষে সমর্থন নিতে তিনি ফজলুল কাদের চৌধুরী থেকে অনেকের কাছে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার জন্য মওলানা ভাসানীদের মতো নেতাদের সমর্থন আদায়ের উচ্চতার নেতা তিনি ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু ’৬৬ সালে আওয়ামী লীগ সম্মেলনের শেষ দিন ২০ মার্চ পল্টনে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘ছয় দফা নিয়ে অনেকের কাছেই গিয়েছিলাম, কেউ সমর্থন করেননি।’ তখন তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’ উচ্চারণ করেন। তিনি বলেছিলেন, কর্মীর দল আওয়ামী লীগ। কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে ছয় দফার আন্দোলনকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা চূড়ান্ত করলে ৪ জানুয়ারি তারা একটি বিবৃতি দেন যা ৫ জানুয়ারির সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ১১ দফা আন্দোলনে তার চেয়ে বড় নেতারা নেতৃত্বে থাকলেও ডাকসু যেহেতু সব ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে তাই ডাকসু ভিপি হিসেবে তাকেই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দেয়। তাই তিনি সব সভা পরিচালনাও করতেন সভাপতিত্বও করতেন।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবদুর রউফ, সাইফউদ্দিন মানিক ও ইব্রাহীম খলিল বেঁচে না থাকলেও আমরা সাতজন জীবিত আছি। সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য যে সত্যের ধারেকাছে নেই তার নিজস্ব মনগড়া উদ্ভট কল্পনাপ্রসূত মনের ফসল তা জীবিত অন্যরাও বলতে পারবেন।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ’৬৯-এর সেই অগ্নিঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ৫ শতাধিক ছাত্রের সামনে টেবিলে দাঁড়িয়ে আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করে আন্দোলনের সূচনা করি। সেদিন সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিল শুরু করলে তৎকালীন ঢাকার ডিসি এম কে আনোয়ার ও পুলিশ সুপার মামুন মাহমুদ পরবর্তীতে ভিআইপি হয়ে সারদায়, একাত্তরে শহীদ ভিসির বাড়ির সামনে অনুরোধ করেন সামনে অগ্রসর না হতে। কিন্তু আমরা তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করলে টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ শুরু হয়। এতে ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ আহত হন। আমরা ডাকসু অফিসে গিয়ে আবার পরদিন কর্মসূচি দিলাম। ৫ শতাধিক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুববিরোধী যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম, ১৮ জানুয়ারি সংগ্রামের স্রোতে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই’। ১৯ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের মিছিল বের হয়েছিল। ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আসাদ উল্লাহ ও পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আহত হন। প্রতিবাদে ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলায় ছাত্র সমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলিবর্ষণ হলে আসাদুজ্জামান নিহত হন। আসাদের লাল রক্তে ভেজা শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের জানাজায় শোকে-ক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র। যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আপসহীন সংগ্রামের শপথ নিতে এসেছে সবাই। মওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতাও এসেছেন জানাজায়। ডাকসু ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশালমিছিল আর ২৪ তারিখ ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২২ তারিখ ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা ওড়ল। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। শোক নয় যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল ঢাকা নগরী। একজন মানুষও ঢাকায় দেখা গেল না যার বুকে শোকের চিহ্ন কালো ব্যাজ নেই। ২৩ তারিখ ঢাকা মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো। প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে উঠল ঢাকায়। ২৪ তারিখ হরতালের সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এলো রাজপথে। বিক্ষোভে উত্তাল নগরী। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ হলো। পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ুরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তমসহ চারজন নিহত হয়। লাশ নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে পল্টনে যাই। সর্বত্র এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ ঢাকার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বালানো হয়। এমএনএ এন এ লস্করের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদের বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এস এ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পালালেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশসহ সবাইকে নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের মাঠে চলে আসি। এখানে আজহার আলী মল্লিক বক্তৃতায় বললেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নেই। তবে তার রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ বিকাল ৩টার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। এদিকে ২০ তারিখ আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা নিয়ে আসত। এখনো ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা জোগায়, তেমনি মতিয়ুরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারী হয়ে আসে। মতিয়ুরের বুক পকেটে পাওয়া চিরকুট নিয়ে দেখলাম, লেখা আছে- ‘মা, তুমি মনে করো তোমার মতিয়ুর বাংলার মানুষ ও প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল। ইতি- মতিয়ুর রহমান, ১০ম শ্রেণি, পিতা আজহার উদ্দিন মালিক, নবকুমার ইন্সটিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিয়ুরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তা হৃদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিয়ুরের মা আমাদের বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিয়ুরের রক্তে ওই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। এদিকে ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। চলবে...

সর্বশেষ খবর