মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাঠের কোন্দলে আওয়ামী লীগ

রফিকুল ইসলাম রনি

মাঠের কোন্দলে আওয়ামী লীগ

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্রই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে। কারও বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে না দল। ভর্ৎসনা, অসন্তোষ প্রকাশ আর উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে আপস-মীমাংসার ওপর জোর দেওয়ায় বেসামাল হয়ে পড়ছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব, এমপি-নেতায় দ্বন্দ্ব, উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম এমপির দ্বন্দ্ব এখন হাত ধরাধরি করে চলছে। এমনকি মারামারি-খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানেও দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নীলফামারীতে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা আহত হয়েছেন প্রতিপক্ষের আঘাতে। এ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকসহ সাধারণ নেতা-কর্মীরা। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকেও।

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরিচালিত হয় দুই নেতার নামে। তাদের একজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আরেকজন সাবেক জাসদ নেতা, সদর আসনের এমপি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। জেলা রাজনীতিতে তাদের দ্বন্দ্বের কথা আওয়ামী লীগের কারোরই অজানা নয়। গত উপজেলা নির্বাচনে সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে। তিনি বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শহরের কর্তৃত্ব হাতছাড়া করতে নারাজ শাজাহান খান। নিজের ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খানকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে নৌকাকে চ্যালেঞ্জ জানান তিনি। উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হেরে যান। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের পর দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। খুন হন পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা ওয়ার্ড যুবলীগের এক নেতা। পরাজিত প্রার্থীর অনুসারীদের ৪০টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আহত হন অন্তত ৩০ জন। এ ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘটনায় সম্প্রতি ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে শাজাহান খান দেখা করতে আসেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। এ সময় শাজাহান খানকে ভর্ৎসনা করেন কাদের। জানা গেছে, ১৯৯১ সালে জাসদ ছেড়ে শাজাহান খানের আওয়ামী লীগে যোগদানের পর দলে বিভক্তি বাড়ে। নাছিমের অনুসারীরা বসেন শহরের পুরান বাজারে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। সেখান থেকে আধাকিলোমিটার দূরে চানমারি এলাকায় শাজাহান খানের কার্যালয়ে বসেন তার অনুসারীরা। দলীয় কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালন করেন তারা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ ও রংপুর-৫ আসনের এমপি এইচ এন আশিকুর রহমানের সঙ্গে জেলা ও মিঠাপুকুর উপজেলা নেতাদের আগেকার দ্বন্দ্ব এখনো দূর হয়নি। সরকারের কোনো উন্নয়নমূলক কাজেও এই এমপির পাশে জেলা নেতাদের দেখা যায় না। এ উপজেলায় ১৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কমিটি ছাড়াও রয়েছে এমপির অনুমোদিত আলাদা কমিটি। একই অবস্থা ১৫৩টি ওয়ার্ডেও। কেন্দ্রীয় এই নেতার সঙ্গে মিঠাপুকুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সরকারেরও দ্বন্দ্ব চরমে। গত উপজেলা নির্বাচনে দল থেকে জাকির হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও এমপি তার পছন্দের প্রার্থী মেজবাহুর রহমান মঞ্জুকে ভোটের মাঠে নামান। ১ লাখ ২৩ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন জাকির হোসেন। আর এমপির অনুমোদিত কমিটি ও তার ছেলে রাশেক রহমানের ‘রাশেক রহমান একান্ত কমিটি’কে কাজে লাগিয়েও জাকিরের ধারেকাছে যেতে পারেননি তাদের প্রার্থী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পান ৩৫ হাজার ভোট। স্থানীয় নেতারা জানান, আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমানের কারণে মিঠাপুকুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাকে ঘিরে দলের স্থানীয় পর্যায়ে নতুন করে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। গত শোক দিবসেও পৃথক কর্মসূচি পালিত হয়েছে মিঠাপুকুর উপজেলায়। সভাপতি-সম্পাদকের সমন্বয়হীনতায় বেহাল দশা সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগে। জেলা সভাপতি সাবেক এমপি মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন। তারা দুজনই নিয়মিত এলাকায় থাকেন না। ফলে দল টানা সাড়ে ১০ বছরে ক্ষমতায় থাকলেও সংগঠনে গতি আসেনি। প্রায় তিন মাস ধরে হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে না যাওয়ায় দলীয় কর্মকান্ডে  সমন্বয়হীনতা আরও বেড়েছে, বলছেন নেতা-কর্মীরা। এ জেলার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন চালকের ভূমিকায় ছিলেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা মুকুট ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়ুব বখত জগলুল। জেলা কমিটি ঘোষণার আগেই মারা যান জগলুল। আর শীর্ষ পদপ্রত্যাশী হলেও মুকুটকে রাখা হয় সহসভাপতি পদে। ফলে মুকুটের দীর্ঘদিনের অনুসারী কিছু নেতা সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে হাত মেলালেও জেলা সদরে নিজের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন তিনি। গত ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ‘হাসিমুখে’ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিতর্কের জন্ম দেন জেলা সাধারণ সম্পাদক ইমন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ সবাই ভাবগম্ভীর অবস্থায় জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের হেসে লুটোপুটি করে শ্রদ্ধা জানানোয় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন নেতা-কর্মীরা।

ফরিদপুর-৪ আসনের বর্তমান এমপি মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। গত দুই সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কাজী জাফরউল্লাহকে হারিয়ে তিনি স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হন। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত। কাজী জাফরউল্লাহ বনাম নিক্সন চৌধুরী গ্রুপ। দলীয় কর্মকা ও সেভাবেই পরিচালিত হয়ে আসছে। সভাপতি-সম্পাদকের বিরোধে বিপর্যস্ত রাজশাহী জেলা ও মহানগরী আওয়ামী লীগ। মহানগরীতে এ বিরোধ কিছুটা ঠা া হলেও জেলায় প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়তই দলের শীর্ষ নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, বক্তব্য দেন। সাম্প্রতিক সময়ে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের বিরোধ এতটাই বেড়েছে যে, এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই বিষোদগার করছেন। মহানগরী আওয়ামী লীগ সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের বিরোধ অনেক পুরনো। সেই দূরত্ব এখনো ঘোচেনি, বরং বেড়েছে। খায়রুজ্জামান লিটন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি) আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভুইয়া। এখানে স্থানীয় এমপির সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে দলের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুরের। আবদুস সবুর এ আসনে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে চান। কিন্তু ‘এলাকা হাতছাড়া’ করতে নারাজ সুবিদ আলী ভুইয়া। এ দ্বন্দ্বে বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। গত রমজানে আবদুস সবুরের পূর্বনির্ধারিত ইফতার পার্টির জায়গায় পাল্টা কর্মসূচির ডাক দেন সুবিদ আলী ভুইয়া ও তার ছেলে মোহাম্মদ আলী সুমনের অনুসারী ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। ফলে পুলিশ সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে। প- হয় কেন্দ্রীয় নেতার ইফতার পার্টি। নেত্রকোনা-৫ আসনের এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের। গত সংসদ নির্বাচনের আগে এ নিয়ে কিছুদিন সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আট মাস পেরিয়ে গেলেও দ্বন্দ্ব মোটেও কমেনি। বরং দূরত্ব কয়েক ধাপ বেড়েছে। জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে নীলফামারীর জলঢাকায় পৃথক দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা আহত হন। আহত হন পুলিশসহ আরও ২২ জন। স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে জলঢাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি গ্রুপ পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে। এক গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা, আরেক গ্রুপের নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আনছার আলী মিন্টু। শোক দিবসে মোস্তফা গ্রুপের অনুষ্ঠান চলাকালে মিন্টুর নেতৃত্বে তার লোকজন এসে বক্তব্যরত আবদুল মান্নানকে ধাক্কা দিয়ে কিল-ঘুষি মারেন। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আনছার আলীর হাতে লাঞ্ছিত হন সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা। এ সময় হামলাকারীরা সমাবেশের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করতে থাকেন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ হতে থাকে। এ সময় পাঁচ পুলিশসহ উভয় গ্রুপের নেতা-কর্মী ও পথচারীরা আহত হন। সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা অভিযোগ করেন, বঙ্গবন্ধু চত্বরে জাতির জনকের জীবনী নিয়ে আলোচনা করছিলেন দলের সাবেক উপজেলা সভাপতি আবদুল মান্নান। এ সময় বর্তমান উপজেলা সভাপতি আনছার আলী মিন্টুর নেতৃত্বে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী নিয়ে অতর্কিত হামলা চালানো হয় আমাদের ওপর। তবে পাল্টা অভিযোগ করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আনছার আলী মিন্টু বলেন, আগে থেকে নির্ধারিত দলীয় কর্মসূচির আলোকে শোক র‌্যালি নিয়ে যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাই সে সময় সাবেক এমপি মোস্তফা ও সাবেক সভাপতি আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে আমাদের ওপর অতর্তিক হামলা চালানো হয়।

সর্বশেষ খবর