শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঠিকাদারির মাফিয়া জি কে শামীম গ্রেফতার

নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, অস্ত্র মাদক উদ্ধার, ৭ গানম্যান আটক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঠিকাদারির মাফিয়া জি কে শামীম গ্রেফতার

যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের অফিসে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব বিপুল পরিমাণ টাকা মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর ঠিকাদারির মাফিয়া গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে তার সাত সশস্ত্র দেহরক্ষীসহ আটক করেছে র‌্যাব। গতকাল সকাল থেকে নিকেতন এ-ব্লক, ৫ নম্বর রোডের ১৪৪ নম্বর বাড়িতে তার অফিসে র‌্যাব দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে। এ সময় তার অফিস থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ৯ হাজার ইউএস ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব বলছে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধ কাজে বৈধ অস্ত্রের ব্যবহারসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে তার নিকেতন বি-ব্লক, ৫ নম্বর রোডের ১১৩ নম্বর বাড়ি থেকে আটক করে তল্লাশির জন্য তার অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। আটক বাকিরা হলেন মো. শহিদুল ইসলাম,  মুরাদ হোসেন, জালাল হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন, কামাল হোসেন।

জানা গেছে, জি কে শামীম যুবলীগের নেতা হিসেবে রাজধানীর সব সরকারি অফিসে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। যুবলীগের একটি বিশাল গ্রুপও এসব ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের সময় তার সঙ্গে থাকত। তার ভয়ে অন্য ঠিকাদাররা বিভিন্ন টেন্ডারে অংশ নিতেন না। অলিখিতভাবে গণপূর্ত, রাজউক, শিক্ষাভবন, পিডিবিসহ সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে জি কে শামীম গংয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। ই-টেন্ডারের কারণে অনেকে কিছু ছোট ছোট কাজ পেলেও জি কে শামীমের ভয়ে তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতেন। তবে র‌্যাবের হাতে আটকের পরপরই যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বলা হয়, জি কে শামীম নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তিনি কমিটিতে নেই।

র‌্যাবের ব্রিফিং : র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব সকালে শামীমের বাসা ও অফিসে অভিযান শুরু করে। এ সময় শামীম ও তার সাতজন দেহরক্ষীকে আটক করা হয়। অভিযানে শামীমের অফিস থেকে তার একটি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও দেহরক্ষীদের সাতটি শটগান এবং নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মোট ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআরের কাগজ জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর তার মা আয়েশা আক্তারের নামে, বাকি ২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার এফডিআর শামীমের নামে। এ ছাড়া তার অফিস থেকে বিদেশি মদের ৫টি বোতল উদ্ধার করা হয়েছে।’

ব্রিফিংয়ে উপস্থিত র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই শামীমকে আটক করা হয়েছে। জি কে শামীমের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে। আমরা সেসব তদন্ত করছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘শামীমের অফিস থেকে জব্দ এফডিআরের টাকাগুলো বিভিন্ন অবৈধ সোর্স থেকে এসেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। আমাদের কাছে আগে থেকেই অভিযোগ ছিল, কিছু অবৈধ সোর্স থেকে তার এফডিআরের টাকাগুলো এসেছে। সেসব অভিযোগ আমরা তদন্ত করে দেখছি। এ বিষয়ে মানি লন্ডারিং আইনে তদন্তকাজ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শামীমকে আদালতে এফডিআরগুলোর সোর্স বৈধ প্রমাণ করতে হবে।’

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘কাউকে নাজেহাল করতে নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার অভিযান চালায়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও এফডিআরের অবৈধ সোর্সের অভিযোগ রয়েছে। যেসব অভিযোগ শামীমের বিরুদ্ধে রয়েছে সেগুলো তিনি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলে ছাড়া পাবেন।’

জব্দ আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ অস্ত্রগুলো বৈধ। তবে অভিযোগ রয়েছে এগুলো অবৈধ কাজে ব্যবহার হতো। তাই জব্দ করা হয়েছে।’

শামীমের রাজনৈতিক পরিচয় বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা তা নির্ধারণ করবেন তার দল ও নেতারা। এ দায়িত্ব আমাদের নয়। তবে যুবলীগের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার স্বীকারোক্তিতে বিভিন্ন অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে জি কে শামীমের নামও উঠে আসে। মূলত খালেদের তথ্যের ভিত্তিতেই জি কে শামীমকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালানো হয়।’ জানা গেছে, সকাল ৭টার দিকে তার বাড়ি ঘেরাও করেন র‌্যাব-১-এর সদস্যরা। এরপর তার সাত দেহরক্ষীকে আটক করে র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা ১২টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা তার বাসায় ঢোকেন। জি কে শামীমকে আটকের পর নিয়ে যাওয়া হয় তার অফিসে। সেখানে টানা ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আটক দেখায় র‌্যাব।

তবে জি কে শামীমের ব্যক্তিগত সহকারী মো. দিদারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘জি কে শামীমের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ হাজার লোক কাজ করে। বেশির ভাগ কাজই সরকারি প্রতিষ্ঠানের।’

কে এই জি কে শামীম : নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার দক্ষিণপাড়া গ্রামের মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। নিজেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পরিচয় দিতেন। বসবাস করতেন বনানীর ডিওএইচএসে। আর নিকেতনে ৫ নম্বর সড়কের ১৪৪ নম্বর ভবনটি তার জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের অফিস। অস্ত্রসহ সাত দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরার বিষয়টি বিভিন্ন সংস্থার নজরে এলেও অনেক প্রভাবশালীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে এত দিন বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগরী যুবদলের সহসম্পাদক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের খুবই ঘনিষ্ঠ। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ওই সময়ও তার বিশেষ অবস্থান ছিল। একটা সময় জি কে শামীম পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার পালাবদল হলেও জিসানের মাধ্যমেই পর্যায়ক্রমে তিনি মহানগরী যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের কাছাকাছি চলে যান। যুবদল নেতা হয়ে যান কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা, সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও। জিসানের মাধ্যমে মহানগরী যুবলীগের প্রভাবশালী গ্রুপের একজন হয়ে উঠলেও একটা সময় ভাগাভাগি নিয়ে জিসানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন জি কে শামীম। শামীমের কারণে জিসান আহমেদের সঙ্গে খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও যুবলীগের ওই নেতার সম্পর্কে ফাটল ধরে। আলাদা হয়ে পড়েন জিসান।

সূত্র বলছে, বাসাবোয় পাঁচটি বাড়ি ও একাধিক প্লট শামীমের। কদমতলায় ১৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটি জি কে শামীমের। এ বাড়িটি ম্যানেজার হিসেবে দেখাশোনা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ইসমাইল হোসেন সর্দার। শামীম কয়েক বছর বাসাবোর ওই বাড়িতে বসবাস করলেও এখন থাকছেন বনানীর ওল্ড ডিওএইচএসে নিজের ফ্ল্যাটে এবং নিজের কার্যালয় বানিয়ে বসেন নিকেতনের একটি ভবনে। বাসাবোয় আরও রয়েছে তিনটি ভবন এবং ডেমরা ও দক্ষিণগাঁও ছাড়াও সোনারগাঁ উপজেলা, বান্দরবান ও গাজীপুরে কয়েক শ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। তবে ভুক্তভোগীদের কেউই নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জি কে শামীমের বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি অফিস-আদালতের কাজ শুরুর আগেই প্রাপ্য বিলের ৮০ শতাংশ তুলে নিতেন শামীম। পরে প্রকৌশলীরা ‘কাজটা শেষ করে দিন’ মিনতি জানিয়ে তার পিছে পিছে ঘুরতেন। রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে জি কে শামীমের জি কে বি অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেডের। এর মধ্যে র‌্যাব সদর দফতরের ৫৫০ কোটি, সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১৫০ কোটি, পঙ্গু হাসপাতালের ২০০ কোটি, বেইলি রোডের ২০০ কোটি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ২০০ কোটি, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ১৫০ কোটি, মহাখালী গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৫০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ অন্যতম। যে কোনো সময় ঠিকাদারির কোনো সাইট ভিজিটে গেলে ১০ জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী ছাড়াও ২০-৩০ জন সশস্ত্র অবৈধ অস্ত্রধারী থাকত। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক যুগ্মসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে জি কে শামীমের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জি কে বিল্ডার্স’ ও ‘দ্য বিল্ডার্স’-এর ৭৫ কোটি টাকার কাজের চাঁদাবজির ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের বিষয়টি বিভিন্ন সময় উঠে আসে বটে তবে অভিযোগ রয়েছে, দিয়াজকে সরিয়ে দিতে পর্দার নেপথ্যে থেকে ইশারা দিয়েছিলেন জি কে শামীম।

বেরিয়ে আসছে অনেক প্রভাবশালীর নাম : সূত্র জানায়, খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমকে আটকের পরপরই অনেক প্রভাবশালীর নাম বেরিয়ে এসেছে। ঠিকাদারি, ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ অনেক অপরাধ কর্মকা- ধামাচাপা দিতে অনেক প্রভাবশালীর কাছে নিয়মিতভাবে পৌঁছে যেত মোটা অঙ্কের মাসহারা। বিশেষ উপহার হিসেবে অনেক সুন্দরী ললনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো ওইসব প্রভাবশালীর কাছে। এ দুজনের কাছ থেকে আদায় করা তথ্য অনুযায়ী ওইসব প্রভাবশালীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে এরই মধ্যে এসব জানানো হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ মহলকে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর