সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
জেলহত্যা দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

খুনিদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুনিদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের খুনিদের দোসর ও মদদদাতাদের স্থান বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনো হবে না। দেশের জনগণকে সেভাবেই চিন্তা করতে হবে, আর যেন সেই খুনিদের রাজত্ব না হয়।

গতকাল রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অডিটরিয়ামে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জেলহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।  জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের নাম পুরোপুরি মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পাকিস্তানের আরেকটি প্রদেশ হিসেবে ফিরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে চলায় জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করা হয়। তাদের হত্যা করে চক্রান্তকারী গোষ্ঠী চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নামটি বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এই দুই হত্যাকান্ডে  মদদ দেওয়ার পাশাপাশি খুনিদের প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই সঙ্গে দলটির বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও তার স্বামীর সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। তিনি বলেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকারে এসে যুদ্ধাপরাধী, জেলহত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। তবে জেলহত্যায় এখনো যে কয়জন খুনি বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে আছে, তাদেরও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কারাবন্দী খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে বলেন, খুনিদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন? জেনারেল জিয়া একজন খুনি। তার স্ত্রী (খালেদা জিয়া) ও ছেলেও (তারেক রহমান) তাই। তারা (খালেদা জিয়া) শত শত মানুষকে হত্যা করেছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে, বিরোধী দলে থাকতেও অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে শত শত মানুষকে বীভৎস কায়দায় হত্যা করেছে, এতিমের টাকা আত্মসাৎ করার দায়ে দি ত হয়ে যিনি এখন কারাগারে, তাদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন? চিকিৎসা নিয়ে এত কথা কেন? তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনি, ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকা  এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিচারের রায় আমরা কার্যকর করেছি। এদের যারা দোসর বা ষড়যন্ত্রকারী, হয়তো আমরা আজকে বিচার করে যেতে পারলাম না, আমরা করার চেষ্টা করব বা আগামীতে যারা আসবে তারা করবে। কারণ ইতিহাস কোনো দিন মুছে ফেলা যায় না। তখন এই ষড়যন্ত্রকারীরাও একসময় ধরা পড়বে। তাদের সে রহস্য উদঘাটন অবশ্যই হবে। কেউ না কেউ এটা করবে, এটা আসবে, এটা হবেই। কেউ না কেউ এসে এদের বিচার করবে, কারণ ইতিহাস কাউকে কোনো দিন ক্ষমা করে না। 

প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে আরও বলেন, একটি দলের (বিএনপি) নেত্রী যিনি এতিমের টাকা আত্মসাৎ করে দি ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বিএনপিতে কোনো নেতা পেল না, যাকে (তারেক রহমান) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হলো সেও দুর্নীতির মামলায় দি ত পলাতক আসামি। বিএনপি একজন ভালো লোককে পেল না দলের দায়িত্ব দিতে। তাই যারা এখন বিএনপি করেন, এত মায়াকান্না করেন, আসলে তাদের মেরুদ  ও আত্মসম্মানবোধ আছে কিনা সন্দেহ হয়।

সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে চলমান সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি, দেব না। দেশের মানুষ যেন সুন্দর ও উন্নত জীবন পায় সেজন্য কাজ করে যাচ্ছি। যারা যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছেন, তাদের স্বপ্ন কখনো ব্যর্থ হতে পারে না। ভবিষ্যতেও হবে না। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দোসর ও মদদদাতাদের বাংলার মাটিতে স্থান হবে না। আর যেন খুনিদের দোসররা কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে না পারে, দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, সেভাবেই দেশের মানুষকে চিন্তা করতে হবে, সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার পাঁচ বছরের দুঃশাসন এবং পরবর্তীতে অগ্নিসন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে আমাদের দেশের মানুষকে হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়ারা একইভাবে দেশের মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেছে, সারা দেশে একই সঙ্গে ৬৩ জেলার ৫০০টি স্থানে বোমা হামলা করেছে। নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে ৬ বছরের শিশুসহ অসংখ্য নারীকে গণধর্ষণ করেছে। ক্ষমতায় থাকতে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর প্রধানদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে লাখো শহীদের রক্ত¯œাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন এই খালেদা জিয়া। ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি পদচ্যুত খায়রুজ্জামানকে এনে পদোন্নতি দিয়ে ফরেন সার্ভিসে চাকরি দিয়েছিলেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় মৃত খুনি পাশাকেও পদোন্নতি দিয়ে তার অবসরের সব সুযোগ-সুবিধাও দিয়েছিলেন তিনি। এ ধরনের জঘন্য অন্যায়-অবিচারও তিনি করে গেছেন। তিনি বলেন, ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরও তারা (বিএনপি-জামায়াত) থেমে থাকেনি। অসহযোগ আন্দোলনের নামে গুলশানের অফিসে থেকে নির্দেশ দিয়ে সারা দেশে অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছেন খালেদা জিয়া। জীবন্ত মানুষকে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে  হত্যা করেছে। বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ সর্বত্রই নাশকতা চালিয়েছে। খালেদা জিয়ার ডাকা সেই অসহযোগ, হরতাল ও অবরোধ এখনো কিন্তু বহাল রয়েছে। তাদের এত অন্যায়, জীবন্ত শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আল্লাহও সহ্য করেননি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের কিছু মানুষ আছে তারা সহজেই অতীতের ঘটনা অল্প সময়েই ভুলে যান। এখন অনেকে কারাবন্দী দি ত একজনকে নিয়ে মায়াকান্না করেন। কিন্তু তাদের কি ৭৫-পরবর্তী হত্যাকান্ডে র শিকার পরিবার, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যার পর তাদের পরিবার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ও পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা এবং অগ্নিসন্ত্রাসে বীভৎস কায়দায় হত্যার শিকার পরিবারের আর্তনাদের কথা কি চোখে পড়ে না? যারা এসব ঘটিয়েছেন, এতিমের টাকা পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছেন, তাদের নিয়ে এত মায়াকান্না ও চিকিৎসা নিয়ে এত কথা কেন বুঝি না।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রীর নামে আরও অনেক দুর্নীতির মামলা রয়েছে। তিনি আদালতে যান না। কারণ উনি (খালেদা জিয়া) ভালো করেই জানেন আদালতে গেলে তার দুর্নীতির প্রমাণ হয়ে যাবে। তাদের দুর্নীতি আমরা নই, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই খুঁজে বের করেছে। তার পুত্রের পাচারকৃত কিছু অর্থ আমরা ফেরতও এনেছি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিএনপি নেতাসহ কিছু মানুষের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, খালেদা জিয়া সেনাপ্রধানের স্ত্রী হিসেবে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমানও সেনাপ্রধান ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া তাকে সিএমএইচে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে দেননি। আমরা যে পদোন্নতি দিয়েছিলাম, সেটিও কেড়ে নিয়েছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত সাবেক এই সেনাপ্রধানকে স্ট্রেচারে করে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। একজন সেনাপ্রধানের স্ত্রী হলেও আরেক সেনাপ্রধানকে চিকিৎসাও নিতে দেননি। এখন তার চিকিৎসা নিয়ে এত কথা কেন? কোন মুখে তারা কথা বলেন? শহীদ জাতীয় চার নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাগার হচ্ছে একটি সুরক্ষিত জায়গায়। সেই কারাগারে বন্দীদের হত্যা করার মতো জঘন্য ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। খুনি মোশতাকের নির্দেশে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারে অস্ত্র নিয়ে ঢোকা যায় না। কিন্তু তারা অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছিল।

প্রথমে জেল কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। তখন বঙ্গভবন থেকে বলা হয়েছিল, আলোচনা করতে যাচ্ছে। যেভাবে ঢুকতে চায়, সেভাবেই ঢুকতে দেওয়া হোক। তিনি বলেন, খুনি মোশতাকের পতন যখনই অনিবার্য হয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একটি প্লেনে করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। প্রথমে খুনিদের ব্যাংককে নিয়ে যায়। সেখানে বসে তাদের পাসপোর্ট দেওয়া হয়। তাদের ভিসার ব্যবস্থা করে কোন দেশে যাবে সেটাও ঠিক করে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে কারা জড়িত, সেটাও কিন্তু ইতিহাসে আছে। একদিন তাদেরও বিচার হবে।

আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, আবদুল মতিন খসরু, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কথাসাহিত্যিক-সাংবাদিক আনিসুল হক, ব্যারিস্টার মহিবুল হক চৌধুরী নওফেল, আনোয়ার হোসেন, এ কে এম রহমতুল্লাহ, শাহে আলম মুরাদ। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিচালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গতকাল সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে তিনি শ্রদ্ধা জানান। সকাল ৭টায় শেখ হাসিনা প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির বেদিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে তিনি জাতির পিতার প্রতিকৃতির বেদিতে আবার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। 

এরপর একে একে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতির পিতার প্রতিকৃতির বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এ ছাড়া গতকাল রাজধানীর বনানী কবরস্থানে জাতীয় তিন নেতার কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বনানী কবরস্থানে এজন্য পবিত্র ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। অপর নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামানের কবর রাজশাহীতে হওয়ায় সেখানেও দলের পক্ষ থেকে জাতীয় এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

সর্বশেষ খবর