বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

হঠাৎ হামলায় উত্তাপ ভোটে

গাবতলীতে তাবিথের ওপর হামলা । আতিকুল বললেন, ওদের নিজেদের সংঘর্ষ । সবকিছু খতিয়ে দেখা হবে : ইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

হঠাৎ হামলায় উত্তাপ ভোটে

গতকাল গাবতলীতে হামলার সময় মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে ঘিরে রক্ষার চেষ্টা দলীয় কর্মীদের -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গতকাল মিরপুরে নির্বাচনী গণসংযোগের সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর দুই দফা হামলা হয়। এতে তাবিথ আউয়াল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, নাজিম উদ্দিন আলম, যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার সাইফুদ্দিন রবিন, সাঈদ খানসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে মিরপুরের আনন্দনগর তেলের মিলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। তাবিথের অভিযোগ, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মুজিব সরোয়ার মাসুমের নেতৃত্বে এ হামলা হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন তাবিথ আউয়াল। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে। অবশ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে বলেন, তাঁরা নিজেরা এ সংঘর্ষ বাধাতে পারেন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে গাবতলী পর্বত সিনেমা হল থেকে তাবিথ আউয়াল গণসংযোগ শুরু করেন। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আনন্দনগরের তেলের মিল এলাকায় এলে পেছন থেকে হঠাৎ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে স্থানীয় শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। এ সময় ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মুজিব সরোয়ার মাসুম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তাবিথকে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। এ সময় দলের নেতা-কর্মীরা তাঁকে ঘিরে বেষ্টনী তৈরি করলেও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালানো হয়। নিক্ষিপ্ত ইট ও কিল-ঘুষিতে তাবিথ আউয়াল মুখ ও মাথায় আঘাত পান। এ ঘটনার পর তৎক্ষণাৎ সেখানে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। এরপর তাবিথ আউয়াল তাঁর বক্তব্যে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এজন্য ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীকে তাঁরা দায়ী করেন। বিএনপি নেতা এ্যানীর বক্তব্যের সময় ফের হামলা চালানো হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন। এ সময় পুলিশ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মাঝে অবস্থান নেয়। পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি। বরং পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তাঁরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের ধাওয়া ও পেটাতে থাকেন। এদিকে হামলার পরও তাবিথ আউয়াল গণসংযোগ চালিয়ে যান। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘কাপুরুষের মতো পেছন থেকে আমাকে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে। আমি স্পষ্ট বলতে চাই, হামলা আমাদের দমাতে পারবে না। আমরা সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার চালিয়ে যাব।’ শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ‘আমাদের ওপর দুই দফা হামলা হয়েছে। আমাদের প্রার্থীসহ ১৫-২০ জন আহত হয়েছেন।’ এ ঘটনার পর গোলার টেক, দিয়াবাড়ী, বর্ধনবাড়ী, বাঘবাড়ী, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড হয়ে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড, লেকভিউ, দক্ষিণ পাইকপাড়া, বটতলা, মধ্যপাইকপাড়া, লালওয়াল, নতুন বাজার, ডি টাইপ কলোনি, কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেট, পোড়া বস্তি, শহীদ মিনার রোড এলাকায় তিনি গণসংযোগ করেন। এসব স্থানে গণসংযোগে তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘আমাদের মাইক ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বাধা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চললে ভোটাররা আতঙ্কের মধ্যে থাকবেন। এ অবস্থা থাকলে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।’ গণসংযোগকালে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, কেন্দ্রীয় নেতা বেলাল আহমেদ, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সাইদুল ইসলামসহ বিএনপি ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এরপর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাফরুলে গণসংযোগ করেন তাবিথ আউয়াল। এতে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, যুবদল সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু যুক্ত হন। পরে কচুক্ষেত স্বাধীনতা চত্বরে পথসভা করেন তাঁরা। সেখানে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী হাবিবুর রহমান রাব্বির (ঘুড়ি প্রতীক) পক্ষে ভোট চান নেতারা। ‘এটা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ’ : ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হামলার বিষয়ে এখনো শুনিনি। তবে তাঁরা নিজেরা সংঘর্ষ বাধাতে পারেন। আমরা সব সময় উন্নয়নের কথা বলে আসছি, এখনো বলব, আমরা চাই উন্নয়ন।’ গতকাল উত্তর সিটির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বেরাইদ মুসলিম হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত নির্বাচনী সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচিত হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সম্প্রতি অন্তর্ভুক্ত হওয়া বেরাইদকে হাতিরঝিল থেকেও সুন্দর করা হবে। নতুন ওয়ার্ডগুলোকে নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। কোন দিক দিয়ে রাস্তা হবে, কোথায় ড্রেন, ফুটপাথ হবে নগর পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে সব পরিকল্পনা করা হয়েছে। গুলশান, বনানী, বারিধারায় যেসব রাস্তা আপনারা দেখেছেন, তার চেয়েও আরও সুন্দর রাস্তা হবে নতুন ওয়ার্ডগুলোয়।’ তিনি বলেন, ‘নতুন ওয়ার্ডগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজাতে রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাথ নির্মাণসহ সব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হতে যাচ্ছে। আপনারা উন্নয়নের মার্কা নৌকায় ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করলে ইনশা আল্লাহ নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোর চেহারা বদলে যাবে।’ এলাকার দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন ঢাকা উত্তরের এই মেয়র প্রার্থী। তিনি বলেন, ‘এ এলাকায় মানুষের অনেক দুর্ভোগ আছে, রাস্তা সরু, জলাবদ্ধতা হয়। আপনারা যদি আমাকে নির্বাচিত করেন, তাহলে বেরাইদ এলাকায় কোনো কাঁচা রাস্তা থাকবে না। রাস্তা, ফুটপাথ, ড্রেন নির্মাণ করা হবে।’ এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, মহানগরী উত্তর যুবলীগের সাবিনা আক্তার, ৪২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রহমান, বাড্ডা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৪ (সাধারণ ওয়ার্ড ৩৭, ৪১, ৪২)-এর প্রার্থী কামরুন নাহারসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা। হামলার তদন্তের নির্দেশ ইসির : তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলার ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বিকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘তাবিথের ওপর হমলার বিষয়ে কমিশনের কাছে বিএনপি তৎক্ষণাৎ অভিযোগ করেছে। কমিশন সেটি শুনেছে। সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য।’

তাবিথের লিখিত অভিযোগ : পূর্বনির্ধারিত পথসভা করার সময় অতর্কিত হামলা ও নেতা-কর্মী-সমর্থকদের আহত হওয়ার বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ঢাকা উত্তরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। গত রাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এ অভিযোগ করেন তিনি।

লিখিত অভিযোগে তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে আমি সিটি করপোরেশন বিধিমালা ২০১৬-এর বিধান পালন করে নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তথা কোটবাড়ী, বাজারপাড়া, হরিরামপুর, গোলার টেক, জহুরাবাদ ইত্যাদি এলাকায় পথসভা ও গণসংযোগে যাই। প্রচারকালে আমার সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক ছিলেন। পথসভা পূর্বনির্ধারিত ছিল। আইনানুগভাবে সংশ্লিষ্ট দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অবহিত করেছি। কিন্তু গণসংযোগ অনুষ্ঠানে আমার নির্বাচনে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আতিকুল ইসলামের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সারওয়ার মাসুম উপস্থিত থেকে অতর্কিতভাবে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার ওপর এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর জঘন্যভাবে আক্রমণ করে।

এ ঘটনায় আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও আমিসহ শারীরিক নির্যাতনে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আমার কর্মী-সমর্থকরা আহত হন। এ নির্যাতন ও আক্রমণের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নিষ্ক্রিয় থাকে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যদি আইন অনুযায়ী আরও সক্রিয় থাকত তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মী-সমর্থকদের শারীরিক নির্যাতন-নিপীড়ন ও জঘন্য আক্রমণ সিটি করপোরেশনের বিধিমালা, ২০১৬-এর বিধিবিধান চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে করি। এ অবস্থায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার জন্য এহেন ন্যক্কারজনক ঘৃণ্যতম আক্রমণের ঘটনা এবং নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’ এ বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম বলেন, ‘আমরা রাত ৮টা ২৫ মিনিটে তার অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর