সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা প্রেরণা

নির্মলেন্দু গুণ

ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা প্রেরণা

১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির দাবি। সেখান থেকেই স্বাধীনতার বীজ উপ্ত হয়েছিল। অনেকে বলেন, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের ভিতরেই স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল। আমার চিন্তা অন্য রকম। ১৯৫৬ সালের পরই ভাষা আন্দোলনের দাবিগুলো মিটে গিয়েছিল। তবে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের আত্মদান থেকে প্রেরণা নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে আন্দোলন করেছিলাম। বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলাম।

স্কুলে আমি ভাষা আন্দোলন দিবস পালন করিনি। ভাষা আন্দোলনের ঢেউটা তখনো আমাদের বর্তমান উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে লাগেনি। ১৯৬২ সালে আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় প্রথম শহীদ মিনারের সঙ্গে পরিচিত হই। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে পারি। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত যায়নি, কিন্তু ছয় দফার প্রভাব পৌঁছেছিল। তাই আমার মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনটা শুরু হয়েছে ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে। তবে ভাষা আন্দোলন থেকে প্রেরণা নিয়ে আমরা ছয় দফা যুদ্ধকে সামনে নিয়ে গেছি। সেজন্য আমরা একটা বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফার দাবিতে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তারা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষেই জীবন দান করে গেছেন। তারাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম শহীদ। আমার সৌভাগ্য আমি তখনই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম। শুরুতেই আমি বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম আমার কবিতার নায়ক হিসেবে। যিনি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, সোনার বাংলার স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন। তিনি ছয় দফা কর্মসূচির ভিতর দিয়ে আমার রক্তের ভিতরে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক। আমরা মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছি। আজ বাংলা সাহিত্য অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ভারতবর্ষে নোবেল না পাওয়া মানে বিশ্বসাহিত্যে দুর্বল এটা মনে করার কারণ নেই। আমি যখন সুইডেনে গিয়েছিলাম, সেখানে একটা গ্রন্থমেলায় তারা বলেছিল যে, বাংলাদেশ একটা দরিদ্র ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত দেশ হিসেবে ইউরোপের মানুষের কাছে পরিচিত। কিন্তু ওই দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রন্থমেলা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী একটা বইয়ের মেলা হয়। এমন দীর্ঘস্থায়ী বইমেলা পৃথিবীতে আর কোথাও হয় না। শুধু যে মাসব্যাপী মেলা হয় তাই নয়, তিন-চার হাজার বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। এত বই কোনো মেলাকে উপলক্ষ্য করে পৃথিবীর কোথাও প্রকাশিত হয় না। এখানে শতভাগ মানুষ শিক্ষিত না। অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন অনেক মানুষ। এখানে শিল্প-সাহিত্যের যে কদর সেটা পশ্চিমের অনেক দেশ থেকে অনেক বেশি। আমাদের সাহিত্য রচনার সঙ্গে যুক্ত যারা তারা পাঠকের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে লেখার ওই প্রেরণাটা পেতেন না। পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার মতো জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে বলেই একুশে গ্রন্থমেলার পরিধি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাঙালি লেখকের সংখ্যা বাড়ছে, বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। সবই ইতিবাচক। এই সাহিত্য যাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় তারাই এর সাহিত্যমূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহিত্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ কারণেই তারা সাহিত্যের বিস্তৃতি চায় না। এ জন্য ‘কিছু হচ্ছে না’, ‘সাহিত্যমূল্য নেই’- এসব বলে তরুণ লেখকদেরকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে। কারণ সাহিত্য অন্ধকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অস্ত্র। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্র। আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা মূলত অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, মানবিক সমাজ গঠনের পক্ষে লেখেন। যত বেশি লেখক হবে তত বেশি প্রগতির শক্তি বৃদ্ধি পাবে। প্রগতিশীল আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে আমাদের সাহিত্য সেই ভাষা আন্দোলন থেকে প্রগতির পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, শোষণ মুক্তির পক্ষে ভূমিকা রেখে আসছে। তাই, ‘কিছু হচ্ছে না’, ‘সাহিত্যমূল্য নেই’- এসব বলে আমাদের প্রকাশনা শিল্পকেও নতুন লেখকদের নিরুৎসাহিত করা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্র। কোনটা ভালো এ ব্যাপারটা আপেক্ষিক। পদ্ম ফুলও ভালো, গোলাপ ফুলও ভালো। একটার সঙ্গে আরেকটার তুলনা করা যাবে না। পৃথিবীতে কোনো খারাপ ফুল ফোটে না। প্রত্যেকে নিজের মতো সুন্দর। সাহিত্যও তেমন।

লেখক : কবি।  অনুলেখক : শামিম আহমেদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর