বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
কাস্টমস কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করল বন্ড সন্ত্রাসীরা

সাংবাদিকদের ওপর হামলা গাড়ি ভাঙচুর, ক্যামেরা ছিনতাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাংবাদিকদের ওপর হামলা গাড়ি ভাঙচুর, ক্যামেরা ছিনতাই

বন্ড সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে সাংবাদিকদের গাড়ি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুরান ঢাকার নয়াবাজারে বন্ড চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযানের সংবাদ সংগ্রহকালে বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের রিপোর্টিং টিমের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে অবৈধ বন্ড সন্ত্রাসীরা। চোরাকারবারি সন্ত্রাসীরা লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে এ হামলা চালায়। হামলাকারীরা সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও ব্যাকপ্যাক ছিনতাই করে নেয়। ভাঙচুর করে তাদের গাড়ি। নজিরবিহীন এ হামলায় নিউজ টোয়েন্টিফোরের রিপোর্টার ফখরুল ইসলাম ও ক্যামেরাপারসন শেখ জালাল গুরুতর আহত হন। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল বেলা ২টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলার আগে হামলাকারী চোরাকারবারিরা অভিযান পরিচালনাকারী কাস্টমস বন্ড কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দেয়। তারা কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আইনপ্রয়োগকারী সদস্যরা তাদের মুক্ত করেন। এরপর পুলিশের সহায়তায় ফের অভিযান শুরু করে। বন্ড সুবিধা নিয়ে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে আসছিল কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সকাল থেকে অভিযানে নামে বন্ড কমিশনারেট। কিন্তু বন্ড মাফিয়া আবুল হোসেন ওরফে বন্ড আবুল, সুজন, বাশারের সন্ত্রাসী বাহিনী আগে থেকেই ছিল প্রস্তুত। তারা শুল্ক কর্মকর্তাদের বাধা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। এদিকে হামলার শিকার সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম বাদী হয়ে বংশাল থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলা নম্বর-৩০। এতে অজ্ঞাত ৭০/৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে তিনি বলেছেন, আসামিরা ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা ও লোহার রড নিয়ে তাদের গাড়ির ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে তাকে, ক্যামেরাপারসন জালাল ও গাড়িচালক রিপনকে গাড়ি থেকে বের করে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে। এ সময় লাইভ করার ডিভাইস, একটি মাইক্রোফোন, গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর করা হয়। একই সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরাসহ দুটি মেমোরি কার্ড চুরি যায়। যার মূল্য ৯ লাখ টাকা। হামলায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৭ লাখ টাকা। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সোহেল রানা জানিয়েছেন, পুলিশ ইতিমধ্যেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। আসামি গ্রেফতার ও ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আরমানিটোলার একটি বাড়িতে বিপুল পরিমাণ বন্ডেড কাগজ মজুদের গোপন খবর পেয়ে সেখানে অভিযান শুরু করে কাস্টমস বন্ডের কর্মকর্তারা। অভিযানের সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার আল আমিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যত বাধাই আসুক বন্ড সুবিধার পণ্য চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। অভিযানের শুরুতে তারা আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তি ও আইনপ্রয়োগকারী সদস্যদের সহায়তায় অভিযান চলে।

আহত প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা কাস্টমস বন্ড কমিশনের একটি অভিযানের নিউজ কাভারেজ করতে নয়াবাজারে যাই। সেখানে আমাদের ওপর অবৈধ বন্ড ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে। তারা আমাদের গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে মারধর করে। এ সময় আমার ক্যামেরাপারসন শেখ জালালও গুরুতর আহত হন। তবে গাড়ির চালক কোথায় আছেন এখনো জানি না। ঢামেক হাসপাতালে আহত সাংবাদিকদের দেখতে এসে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন ফকির জানান, কাস্টমস বন্ড কমিশনের একটা অভিযান ছিল নয়াবাজার কাগজ মার্কেট এলাকায়। এ সময় নিউজ টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিকরা গাড়ি নিয়ে জিন্দাবাহার এলাকায় নিউজ কাভারের জন্য গেলে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তারা গাড়ি নিয়ে আরমানিটোলা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানেও তাদের ওপর হামলা করা হয়। যারা তাদের ওপর হামলা করেছেন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনাস্থলে সরেজমিন দেখা যায়, আরমানিটোলা খেলার মাঠের উল্টো পাশের একটি ১০ তলা ভবনের নিচে থাকা বন্ড সুবিধা আমদানি হওয়া বিপুল পরিমাণ অবৈধ কাগজের গুদামে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের একটি বড় টিম। সংস্থাটির উপকমিশনার রিজভী আহমেদ ও সহকারী কমিশনার আল আমিনের নেতৃত্বাধীন পরিচালিত ওই টিমে পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন। অভিযানের খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হতে থাকেন বন্ড মাফিয়াদের গডফাদার আবুল হোসেন ওরফে বন্ড আবুল, সুজন, বাশার ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ী নামধারী চোরাকারবারি চক্রের শত শত সদস্য। তারা দুপুরে কয়েক ঘণ্টা কাস্টমস কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় বিপুলসংখ্যক চোরাকারবারির উপস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েন কাস্টমস ও পুলিশ সদস্যরা।

ওই অভিযানের খবর সংগ্রহ করতে ঘটনাস্থলে যান বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা। এ সময় নয়াবাজারের কাছে বাবুবাজার মাজার এলাকায় বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের গাড়ি দেখেই হামলা চালায় চোরাকারবারিরা। বন্ড চোরাকারবারিরা নিউজ টোয়েন্টিফোরের রিপোর্টার ফখরুল ইসলাম ও ক্যামেরাপারসন শেখ জালালকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেদম প্রহার ও মারধর করে। হামলাকারীরা নিউজ টোয়েন্টিফোরের রিপোর্টিং টিমের ব্যাকপ্যাক ও ক্যামেরা কেড়ে নেয় এবং প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি ভাঙচুর করে। অবৈধ বন্ড মাফিয়াদের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের হাতে গুরুতর আহত রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয় বাসিন্দারা। বর্তমানে তাদের ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলছে।

এদিকে নয়াবাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বন্ড চোরাচালানে জড়িত বন্ডের ৬৭ মাফিয়ার কাছে জিম্মি দেশীয় কাপড়, এক্সেসরিজ, সুতা, কাগজ, প্লাস্টিক শিল্প খাতগুলো। এই মাফিয়াদের গডফাদার ও তাদের সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজারে এ সিন্ডিকেটের মাফিয়া-গডফাদাররা প্রতি বছর সরকারকে ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ববঞ্চিত করছে। মাফিয়াদের কারণে টেক্সটাইল, কাগজ, প্লাস্টিক, দেশীয় বিভিন্ন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবুল মার্কেটের সানফ্লাওয়ার ট্রেডিংয়ের মালিক আবুল হোসেন ওরফে বন্ড আবুল, নূরজাহান মার্কেটের ফনিক্স ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুর রহিম, ফাল্গুনী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কালাম সুমন, গ্লোডেন বার্ড ইন্টারন্যাশনালের মালিক অনিল, খালেদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুল মতিন জুয়েল, আলম ট্রেডিংয়ের মালিক আলমগীর হক, বিনিময় পেপারের মালিক দুলাল, রহমত এন্টারপ্রাইজের মালিক রহমত, চৌধুরী মার্কেটের সুজন, হক ট্রেডিংয়ের মালিক জাহাঙ্গীর, সোনা মিয়া মার্কেটে সিটি পেপারের মালিক বাসার, উরিচর মার্কেটের সিয়াম অ্যান্ড সেফা দোকানের মালিক সেলিমসহ অন্য মাফিয়ারা এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের অপকর্ম থামাতে পারছে না কেউ। বন্ড মাফিয়া হিসেবে চিহ্নিত একেকজন রাঘববোয়ালের ৮-১০টি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলেই বন্ড সুবিধার আওতায় কোটি কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে ছাড়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর