বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
মমতার উৎকণ্ঠা, সেনা চান কেজরিওয়াল

দিল্লিতে ব্যাপক সংঘর্ষ নিহত বেড়ে ২৭

গৌতম লাহিড়ী, নয়াদিল্লি

দিল্লিতে ব্যাপক সংঘর্ষ নিহত বেড়ে ২৭

দিল্লিতে গতকাল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থান -এএফপি

ভারতের রাজধানী দিল্লির উত্তর-পূর্ব এলাকায় চলমান সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় এক মাসের জন্য কারফিউ জারি করেও সুফল মিলছে না। কারফিউ ভঙ্গ করে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে। চার দিন ধরে চলতে থাকা এই সংঘর্ষে মারা গেছেন ২৭ জন, আহত হন ২ শতাধিক। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল প্রথমবারের মতো তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে টুইট বার্তায় রাজধানীবাসীকে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার  আহ্বান জানান। এদিকে, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করেন। বিজেপি সোনিয়ার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। সোনিয়া কংগ্রেস সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অমিত শাহ এতদিন কোথায় ছিলেন? কেন দাঙ্গাবাজদের দমন করলেন না? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা নামানোর দাবি জানিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এ সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। টুইট বার্তায় মোদি বলেন, ‘দিল্লির ভাই-বোনদের আমি সব সময় শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ মোদি বলেন, পরিস্থিতির ওপর তিনি সর্বদা নজর রাখছেন। বুধবার পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক এক বৈঠক হয়। এতে তিনি উপস্থিত ছিলেন।

গণমাধ্যমগুলো বলছে, সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের নিয়ে ক্ষমতাসীন এক বিজেপি নেতার বক্তব্যের পরপরই এ দাঙ্গা বেধে যায়। বিজেপির ওই নেতা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফরের পর দিল্লির আন্দোলনকারীদের ‘পিটিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন। দিল্লির এ দাঙ্গার কারণে ভারতে ট্রাম্পের দুই দিনের সফরও অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে বলে মত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। ট্রাম্প ভারত ছাড়ার পর থেকেই পরিস্থিতি সামলাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ বাড়তে শুরু করে। বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করেছেন বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। দোভাল মঙ্গলবার রাতে সংঘাতমুখর এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছিলেন। ওইদিন বিবদমান বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে লাগাতার পাথর ছোড়াছুড়ি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। বুধবার সকালেও বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও পাথর নিক্ষেপের খবর পাওয়া গেছে। ভজনপুরা এলাকার একটি ব্যাটারির দোকানে আগুন দেওয়া হয়েছে। দোকানটি ভাঙচুরের পর জ্বলতে থাকা ব্যাটারিগুলোকে রাস্তায় ফেলা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লি পুলিশের ভূমিকায় ভারতের উচ্চ আদালতও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সহিংস এলাকাগুলোর বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে। সরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় পুলিশকে দেখামাত্র গুলিরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দিল্লির উত্তরপূর্বাঞ্চলে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। কোথাও কোথাও অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছে। বুধবার সকালে এই এলাকাগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দেখাচ্ছিল। বিবিসি বলছে, দিল্লিতে এমন সহিংসতা গত কয়েক দশকেও দেখা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জোহরিপুরে রাস্তায় নামে পুলিশ। গোকুলপুরীর ভাগীরথী বিহার এলাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামে সিআরপিএফ, এসএসবি, সিআইএসএফ এবং পুলিশের যৌথ বাহিনী। সীলামপুর, জাফরাবাদ, মৌজপুর, গোকুলপুরীতে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, গতকাল নগরীর চান্দবাগ এলাকায় সিএএ-এর সমর্থক ও বিরোধীদের পরস্পরের দিকে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। সংহিসতা হয়েছে উত্তর-পূর্বের ব্রহ্মপুরী-মুস্তাফাবাদ এলাকায়। গোকুলপুরীতে একটি পুরনো জিনিসপত্রের দোকানেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোকে সংঘাতের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সাবধান করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফর চাপা পড়ে যাচ্ছে সহিংসতার খবরে। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে তৃতীয়বার দিল্লি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে এই সংঘাতে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। বিতর্কিত এই আইন বাতিলের দাবিতে নানা কর্মসূচিও চালিয়ে যাচ্ছিল মুসলিমরা। ক্ষমতাসীন দল বিজেপি আইনের পক্ষে কর্মসূচি নিয়ে নামলে দেখা দেয় সংঘাত। গত মঙ্গলবার রাতভর কেজরিওয়ালের বাসভবনের সামনে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বহু লোক জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখায়। তারা সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। কিন্তু ভোররাতে দিল্লি পুলিশ জলকামান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এনডিটিভি বলেছে, আগের দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যথেষ্ট পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করায় সোমবারই দিল্লির একাধিক মেট্রো স্টেশন বন্ধ রাখা হয়েছিল। জাফরাবাদ, মৌজপুর-বাবরপুর, গোকুলপুরী, জোহরি এনক্লেভ ও শিব বিহার স্টেশন বন্ধ রাখা হয়। উত্তর-পূর্ব দিল্লির সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে।

দিল্লিতে সেনা নামানোর দাবি কেজরিওয়ালের : সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লি। বিক্ষোভকারীরা ঘেরাও করেছিল মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বাড়ি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দিল্লিতে সেনাবাহিনী নামানোর দাবি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গতকাল টুইট করে এ কথা জানিয়েছেন তিনি।

টুইটে লিখেছেন, ‘উত্তর-পূর্ব দিল্লির পরিস্থিতি ক্রমশই আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এবার সেনা নামানো উচিত। গত মঙ্গলবার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বৈঠকের ২৪ ঘণ্টা পরেই দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা নামানোর দাবি জানালেন তিনি। ইতিমধ্যেই সংঘর্ষ চলা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে টহলদারিতে নেমেছেন ভারতের আধা সামরিক বাহিনী।

মমতার উদ্বেগ : দিল্লিতে সংঘর্ষের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মমতা বলেন, ‘শান্তি বজায় রাখা সবার দরকার। যা ঘটছে, তাতে খুবই উদ্বিগ্ন। সবাইকে বলছি শান্তি বজায় রাখুন’। এদিন ভুবনেশ্বর যাওয়ার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, শান্তি বজায় রাখা সবার দরকার। আমাদের দেশ শান্তির দেশ, মানবতার দেশ। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার দেশ। এখানে হিংসার কোনো স্থান নেই। সবার কাছে শান্তি বজায় রাখার আর্জি রাখছি। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি’।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর