শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

তারের জালে ঢাকা

► অপসারণে অভিযান চলছে, অন্যদিকে তার ঝুলিয়ে ইন্টারনেট, ক্যাবল সংযোগ অব্যাহত ► বাড়ছে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

তারের জালে ঢাকা

তারের জঞ্জালে ঢেকে আছে পুরো নগরী। রাজধানীর হাতিরপুল থেকে গতকালের ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজার এলাকার আশপাশে ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল। আশপাশের বাসাবাড়ির বারান্দার কাছ দিয়ে ঝুলন্ত তারের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটিতে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে তার। সম্প্রতি ওই এলাকায় ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের (ডিএসসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ তারের সব লাইন কেটে দেয়।

ডিএসসিসির কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবারও ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড ও টিভি ক্যাবলের সংযোগ দেয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আগের মতোই ঝুলতে দেখা যায় অবৈধ তারের বোঝা। শুধু হাতিরপুল এলাকায় নয়, পুরো রাজধানীই এখন তারের জালে              আটকা। মাথার ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার ঝুলছে ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকায়। বিশেষ করে রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল, আরামবাগ, পল্টন, কারওয়ান বাজার, বনানী, মহাখালী, গুলশান, ধানমন্ডি, মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগ এবং পুরান ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় ক-ুলী পাকানো তার ঝুলে আছে। রাজধানীর প্রতিটি অলিগলির চিত্র আরও ভয়াবহ। প্রধান সড়কে প্রায়ই সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগের অভিযানের কারণে এসব ঝুলন্ত তার অলিগলিতে ছড়িয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটছে মাঝেমধ্যেই। সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে রাজধানীর। ঝুলে থাকা ডিশ বা ইন্টারনেটের ক্যাবল থেকেও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবৈধ তারের জঞ্জাল সরাতে উচ্চ আদালতের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর অনীহার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাটির নিচ দিয়ে সব তারের সংযোগ নিতে আমরা ধানমন্ডিতে পাইলট প্রজেক্ট নিয়েছি। এরই মধ্যে উপযোগিতা যাচাইও হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে ডিএসসিসি মেয়রের সঙ্গে বৈঠক আছে। আশা করছি শিগগিরই কাজ শুরু করতে পারব। একপর্যায়ে আমরা পুরো ঢাকায় সব তার মাটির নিচ দিয়ে সংযোগের আওতায় নিয়ে আসব।’

জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজধানীতে ঝুলে থাকা বিদ্যুৎ, ডিশ ক্যাবল, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি), মোবাইল কোম্পানি, বিটিসিএলের ল্যান্ড ফোনের তারসহ সব ধরনের তার বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো মাটির নিচ দিয়ে স্থাপন করা হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ এক দশক ধরে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরে নবনির্বাচিত দুই মেয়রও তারের জঞ্জাল সাফ করে ভূগর্ভ দিয়ে সেবা লাইন সংযোগ দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে ঝুলে থাকা তারে নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। অবৈধ তার কাটতে অভিযান চলছে। এটা ভালো উদ্যোগ। মাটির নিচ দিয়ে তারের সংযোগ নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সেবা গ্রহণকারীদেরও ভূমিকা পালন করতে হবে।’

নগর ঘুরে দেখা যায়, তারের জঞ্জালে সড়কের দামি বৈদ্যুতিক ও সড়কবাতির খুঁটির ক্ষতি হচ্ছে। ঝুলতে ঝুলতে অনেক স্থানে তারগুলো মাটি পর্যন্ত স্পর্শ করছে। এ কারণে অনেক পথচারি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটেন না। এগুলো থেকে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়া ঝুলে থাকা ডিশ বা ইন্টারনেটের ক্যাবল থেকে অগ্নিকা-ও ঘটছে। কখনো দেখা যায়, পুরনো তারে ত্রুটি দেখা দিলে সেগুলো না কেটেই নতুন তার লাগিয়ে নেয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে তারের তৈরি জঞ্জাল দিন দিন বেড়েই চলেছে।

২০০৯ সালে মাটির নিচ দিয়ে বিভিন্ন তারের লাইন সংযোগ দিতে একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) প্রকল্পের আওতায় দুটি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম এবং সামিট কমিউনিকেশনকে মাটির নিচে তার সরিয়ে অবকাঠামো স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, তাদের তৈরি ভূগর্ভস্থ ফাইবার অপটিকসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেবা দেবে সংস্থাগুলো। এতে পুরো দেশে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় সব প্রতিষ্ঠান মাটির নিচ দিয়েই তাদের সংযোগ প্রদান করতে পারবে। প্রকল্প অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলোর তার মাটির নিচে চলে গেলেও বেশির ভাগ ডিশ-ক্যাবল অপারেটর আর ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের তার এখনো মাটির ওপরেই রয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক কিংবা সড়কবাতির খুঁটির সঙ্গে পেঁচিয়ে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক আকার ধারণ করেছে।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ লাইন মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন। রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় ডেসকোর ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন এরই মধ্যে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্যাবল অপারেটর ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবেই বিদ্যুতের খুঁটি ব্যবহার করে তাদের তার ঝুলিয়ে রেখেছেন। তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছেন না। বিভিন্ন সময় এই অবৈধ তার কেটে দিলেও আবার লাইন লাগিয়ে দিচ্ছেন তারা। এদিকে সরকারি খুঁটি অবৈধভাবে ব্যবহার করে তারের লাইন সংযোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ৫ আগস্ট থেকে সিটি করপোরেশনের দুজন নির্বাহী মেজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এ অভিযান চলছে। দক্ষিণে নগর ভবনের আশপাশ এলাকায় ঝুলে থাকা অবৈধ তার কাটতে অভিযান চালিয়েছেন ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী মেজিস্ট্রেট মো. মুনিরুজ্জামান। এ সময় তিনি বেশ কিছু অবৈধ লাইন অপসারণ করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীতে তার সংযোগে খুঁটি ব্যবহার করতে হলে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিতে হয়। একটি নির্দিষ্ট নিয়মে তার সংযোগ দেওয়া যায়। যারা বিধি ভেঙে তার সংযোগ দিয়েছেন সেগুলোই অবৈধ। এগুলো আমরা কেটে ফেলছি। এটা অব্যাহত থাকবে।’ ডিএসসিসির আরেক নির্বাহী মেজিস্ট্রেট ইরফান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীতে অবৈধ তারের সংযোগ কত তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। তবে ক্যাবল আইনের ২৬ ধারায় বলা আছে, সরকারি বা আধাসরকারি সম্পত্তি ব্যবহার করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ক্যাবল বা ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড লাইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তা করেন না। নিয়ম-নীতি মেনেই আমরা অবৈধ তার কাটছি।’

মাটির নিচে কবে যাবে : নতুন বছর থেকে রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তারের জঞ্জাল পাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবার কাজ শুরু করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সিলেটে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম চালু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সিলেট নগরের টেলিফোন, ইন্টারনেট, ক্যাবল লাইনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সব তার ভূগর্ভে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। একইভাবে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও কেরানীগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য শহরে মাথার ওপর ঝুলে থাকা তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ঢাকার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তারের জঞ্জাল সরাতে চীনের অর্থায়নে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ডিপিডিসি। ২০২৫ সালের মধ্যে রাজধানীর সব এলাকার বিদ্যুতের তার মাটির নিচে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর