সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

খন্ড-বিখন্ড জোট ফ্রন্ট নিয়ে বিব্রত বিএনপি

মাহমুদ আজহার

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি। সর্বশেষ এই সংগঠনটির খন্ডিত একটি অংশ গতকাল কনভেনশন করে ১০১ সদস্যের কমিটি গঠন করে। এতে সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক রতনকে। আর সাধারণ সম্পাদক করা হয় এম এ গোফরানকে। অন্যদিকে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জেএসডির একটি অংশের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই চলছে তাদের কার্যক্রম। ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক গণফোরামও পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারে দুই খন্ডে বিভক্ত। ড. কামাল হোসেন ও ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন খন্ডিত একটি অংশ গণমাধ্যমে কেবল বিবৃতি দিয়েই কার্যক্রম শেষ। মোস্তফা মহসীন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বে গণফোরামের আরেকাংশ দল গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০-দলীয় জোটেও শান্তি নেই। জাতীয় মুক্তিমঞ্চ ইস্যুতে মতবিরোধে বিএনপির সঙ্গে কর্নেল (অব.) অলি আহমদের শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে জোটের কোনো কর্মসূচিতেও এখন যান না অলি আহমদ। তার নিজ দলেও এর প্রভাব পড়েছে। এলডিপি এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে একটি অংশ চলছে কোনো মতে। অন্যদিকে দলটির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আবদুল করিম আব্বাসী ও সাবেক এমপি আবদুল গনিরা মিলে এলডিপির আরেকাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আজ তারা বিএনপি নেতাদের নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে দলের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও পালন করবে।

জোটের অন্যতম বড় শরিক জামায়াতের কিছু নেতা সম্প্রতি দল থেকে বেরিয়ে ‘এবি পার্টি’ নামে নতুন দল গড়ার ঘোষণা দেন। ১১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে সাবেক সচিব এ এফ এম  সোলায়মান চৌধুরীকে। আর সদস্য সচিব করা হয়েছে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে। এ নিয়ে বিএনপি জোটেও অস্বস্তি বিরাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষনেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় ক্রান্তিকালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোট ২০-দল এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়। দুই জোটের কার্যক্রম দৃশ্যমান আছে। তবে কোনো কোনো দলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকতে পারে। এটা তাদের দলের বিষয়। দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন এবং জনগণের জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনই মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী এ দলগুলো ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়াটাই স্বাভাবিক। তারপরও আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আছি, থাকব। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোতে ভাঙাগড়া হয় সরকারের চাপে বা লোভে পড়ে। আবার শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে অবমূল্যায়নসহ নানা কারণেও দলগুলো ভাঙে। জানা যায়, দিন যতই যাচ্ছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো খন্ড বিখ- ন্ডচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে থাকা দলগুলো ক্রমেই ভগ্নাংশে পরিণত হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত বাদে জোট-ফ্রন্টের শরিক দলগুলো ক্রমেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি দলের সিনিয়র দুই নেতার পদত্যাগে এমনিতেই অস্বস্তিতে বিএনপির নীতি নির্ধারকরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই ২০ দল ছেড়েছে আন্দালিব রহমান পার্থের দল বিজেপি। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট ছেড়েছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এ ছাড়া গণফোরাম, জেএসডি, এলডিপিও দুই ভাগে বিভক্ত হয়। জোট-ফ্রন্টের শরিক দলগুলোর বেহাল অবস্থায়ও উদ্বিগ্ন বিএনপি।

২০ দলে ভাঙাগড়া : জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই জোট থেকে প্রথমেই বেরিয়ে যান এরশাদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশীদার হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি এবং তাঁর দল ক্ষমতার ভাগীদার। এরপর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১৮-দলীয় জোট। পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা পরিণত হয় ২০-দলীয় জোটে। বিএনপির এই জোটে প্রথম ভাঙন লাগে ২০১৫ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জোট থেকে বেরিয়ে যায় শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। প্রয়াত নীলুর অভিযোগ ছিল, ২০-দলীয় জোটে বিএনপি-জামায়াত সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিত। এর পরের বছরই ফের ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দীর্ঘদিনের জোটের সম্পর্ক ত্যাগ করে ইসলামী ঐক্যজোট। সরাসরি কাউকে দায়ী না করলেও নিজ সংগঠনকে শক্তিশালী করতে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী। এরপর ভাঙন লাগে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (এনডিপি)। এ ছাড়া খন্ড বিখন্ড হয় লেবার পার্টি ও জাগপা। সেক্ষেত্রে সব দলের একটি অংশ থেকে যায় ২০ দলে। সর্বশেষ ভাঙে এলডিপি। আজ এলডিপির দুই অংশ পৃথকভাবে ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে। রাজধানীর পূর্ব পান্থপথে (এফডিসি সংলগ্ন) দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অলি আহমদের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে। অন্য দিকে শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে এলডিপির আরেকাংশ জাতীয় প্রেস ক্লাবে পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে। দলের দুই ভাগ প্রসঙ্গে অলি আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এলডিপি একটাই। অন্য কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। আমার দল ২০-দলীয় জোটে আছে। তবে শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, তারাই এলডিপির মূল শক্তি। কর্নেল অলি একজন বিতর্কিত নেতা। আমরা মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে মাঠে আছি এবং বিএনপি জোটে আছি। 

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে ২০-দলীয় জোটের যতটুকু সক্রিয় হওয়া কাম্য ছিল, ততটুকু সক্রিয় আমরা নই। আমার ধারণা, জোটের প্রধান শরিক বিএনপি তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। একটি হলো, তারা আসলে জোটবদ্ধ রাজনীতি করবেন কিনা। দ্বিতীয়ত : জোটবদ্ধ রাজনীতি করলে ২০-দল না ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে আগাবেন। তৃতীয়ত : দুই জোটকে বাদ দিয়ে নতুন কোনো জোট করবে কিনা। এসব কারণেই হয়তো জোটের বৈঠক হচ্ছে না। কবে বৈঠক হবে তাও জানি না।

সর্বশেষ খবর