বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সাদাকাতুল ফিতর ও জাকাত

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সাদাকাতুল ফিতর ও জাকাত

জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। মাহে রমজানে প্রতিটি ইবাদতে ও নেক আমল করলে যেহেতু অধিক সওয়াব মেলে সেহেতু মাহে রমজানকে জাকাত আদায়ের মাস বা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রমজান মাস শেষে ঈদ উদ্যাপনের আগে ফিতরা প্রদানের যে বিধান রয়েছে তা জাকাত থেকে আলাদা এবং সক্ষম ব্যক্তির জন্য জাকাত দান করা ফরজ। আরবি শব্দ জাকাতের অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। জাকাত    জাকাতদাতার ধনসম্পদের প্রবৃদ্ধি সাধন করে, পবিত্র করে, ক্রমবৃদ্ধি ঘটায়। জাকাত প্রদান করায় শুধু ধনসম্পদের সমৃদ্ধি সাধনে সীমাবদ্ধ থাকে না, জাকাত দানকারীর মন-মানসিকতার তথা ধ্যান-ধারণার সৌকর্য সাধিত হয়। আল কোরআনে সালাত বা নামাজ কায়েমের নির্দেশের পরপরই প্রায় ক্ষেত্রেই জাকাত আদায়ের কথা এসেছে। নামাজ ও রোজা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবী ও রসুলের শরিয়তেই ফরজ ছিল। কোরআনে ১৯ সুরা মারয়ামের ৩১ আয়াতে হজরত ঈসা (আ.), ৫৫ আয়াতে হজরত ইসমাঈল (আ.) এবং ২১ সুরা আম্বিয়ার ৭২ নং আয়াতে হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত ইসহাক (আ.) এবং হজরত ইয়াকুব (আ.) কেও জাকাত প্রদানের জন্য ওহি নাজিল করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ বা সঞ্চয় থাকলে জাকাত আদায় আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু জাকাতের প্রাপক কারা এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের অবকাশ রয়েছে। ৯ম সুরা আত তওবার ৬০ নং আয়াতে কারা জাকাতের প্রাপক তার তালিকা রয়েছে। দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, দুস্থজন সাধারণত জাকাতের দাবিদার। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আল কোরআনে জাকাতের প্রাপক হিসেবে আরেক বিশেষ শ্রেণির দাবিদারের কথা বলেছেন। ‘ইহা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আলার পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে দেশময় ঘোরাফেরা করতে পারে না; যাচ্ঞা না করার জন্য অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত বলে মনে করে, তুমি তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে যাচ্ঞা করে না। যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা বাকারা। আয়াত ২৭৩)। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বা পরিবার আছে যারা সাহায্যপ্রার্থী হতে পারে না সামাজিক মান মর্যাদার কারণে, কিংবা তারা সংকোচবোধ করে সাহায্য চাইতে, অথচ দেখলে বোঝা যায় তারা দৈন্যদশায় আছে এবং তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। জাকাত আদায়কে সম্পদশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে দুস্থ দরিদ্রদের প্রতি সাহায্যের আদেশ প্রতীয়মান হলেও এটি মূলত জাকাত আদায়কারীর কল্যাণ প্রবৃদ্ধির জন্যই। আল কোরআনে স্পষ্ট করা হয়েছে, ‘ধনে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সুদে যা দিয়ে থাক, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে না; কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে জাকাত তোমরা দিয়ে থাক তাই-ই বৃদ্ধি পায়, তারাই সমৃদ্ধিশালী’ (সুরা রূম। আয়াত ৩৯)। প্রকৃত প্রস্তাবে কারও যদি ১০০ টাকার সম্পদ অর্জিত হয় ওই আয়ের সে মালিক মাত্র ৯৭.৫০ টাকার এবং বাকি ২.৫০ টাকা জাকাত প্রাপকের হক। ‘ধনীর সম্পদের ওপর দরিদ্রের হক রয়েছে’ আল কোরআনের এই নির্দেশনার আলোকে ১০০ টাকায় ২.৫০ টাকা জাকাত দেওয়া ধনবানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি নিঃস্ব দরিদ্র দাবিদারের প্রতি নিছক অনুকম্পা ও দয়া প্রদর্শন নয়। এটি সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানসম্মত ঐশী বিধান। এটি পালিত না হলে পুরো ১০০ টাকা আয়ের মধ্যে গলদ থেকে যাবে। কেউ যদি তার প্রকৃত আয়ের হিসাব প্রদর্শন করে তার ওপর প্রযোজ্য কর রাষ্ট্রকে পরিশোধ না করে তাহলে তার ওই ‘অপ্রদর্শিত’ সমুদয় আয় আইনের দৃষ্টিতে ‘কালো টাকা’ এবং এর জন্য তাকে পদে পদে জবাবদিহি তথা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। মাহে রমজানে একটি অন্যতম করণীয় বিষয় হলো দরাজ দিলে দান খয়রাত করা। ভোগের নয়, ত্যাগের শিক্ষাই সিয়াম সাধনার অন্যতম শিক্ষা ও অনুধাবনের বিষয়। মাহে রমজানে প্রতিটি ভালো কাজ কিংবা ইবাদতের জন্য অন্য মাসের চাইতে ১০ গুণ সওয়াব বেশি পাওয়া যায়। সে কারণে এ মাসে যত বেশি দান-খয়রাত, সাদাকা ও জাকাত আদায় করা যায় তত ভালো। দান-খয়রাত সাদাকা কিংবা জাকাত শুধু টাকা-পয়সা কিংবা সামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে আদায়যোগ্য তা কিন্তু নয়। যার বিত্ত নেই, কিন্তু সময় আছে, শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞান আছে; সে শ্রম দিয়ে, জ্ঞানবুদ্ধি দান করে জাকাত সাদাকা আদায় করতে পারে। হাদিসে বর্ণিত আছে- নেক আমল, সদ্ব্যবহার এবং হাসিমুখে কথা বলাও সাদাকা। অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করাও সাদাকা। ‘সাদাকাতুল ফিতর’কে ব্যবহারিক অর্থে ফিতরা বলা হয়। রমজানের শেষে ঈদ উদ্যাপনের দিন কিংবা তার কিছু আগে থেকে মাথাপিছু যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য গরিব-মিসকিনদের সাদাকা বা দান করা হয় তাকে সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়। রোজার মাসের শেষ ভাগে এসে সাদাকা হিসেবে ফিতরা দেওয়া হয় বলে রোজার শেষে যে ঈদ উদ্যাপিত হয় ভারতীয় উপমহাদেশে তাকে ঈদুল ফিতর বলা হয়। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইনে ‘আদিল ফিতরি’কে হরিরায়া পুয়াসা বা রোজার শেষে আনন্দ উৎসব বলা হয়। মাহে রমজানের শেষে সাদাকা হিসেবে ফিতরা দানের প্রথম উদ্দেশ্য, গরিব মিসকিনগণ যাতে সব মুসলিমের সঙ্গে ঈদের জামাতে ও আনন্দ উদ্যাপনে শরিক হতে পারে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, সিয়াম সাধনায় সতর্কতা সত্ত্বেও যেসব ত্র“টি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, সেসবের প্রতিবিধানের সুযোগ এনায়েত হয় ফিতরা দানের দ্বারা।

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর