রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

আসছে ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট

মানিক মুনতাসির

আসছে ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট

আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। চলতি বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে জীবন-জীবিকাকেই

প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এজন্য করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি টেনে তুলতে গত বছর সরকারের নেওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচিগুলো চালু থাকবে আগামী অর্থবছরও। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের আয় কমেছে। ফলে বছর শেষে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। আর তাই সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতি এমনিতেই বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে। ফলে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে বাজেট ঘাটতিতে। দীর্ঘদিন পর যা প্রথমবারের মতো জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থ বিভাগ সূূত্রে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের আগের টানা দুই দিন বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাধিক ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বৈঠকেই আগামী বাজেট-সংক্রান্ত   এসব বিষয় স্থির করা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ৩ জুন জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। করোনা মহামারী বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত করা হবে বাজেট অধিবেশন।

সূত্র জানান, সামগ্রিক উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে মন্দা বিরাজ করায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হচ্ছে। চলতি বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে করকাঠামোয় খুব একটা পরিবর্তন আসছে না। জনগণের কাঁধে নতুন করের বোঝা না চাপানোর কৌশল নিয়েছে সরকার। তবে আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে করজাল বিস্তৃত করা হবে। করযোগ্য মানুষকে করের আওতায় আনা হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে কমানো হতে পারে করপোরেট কর। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আসছে বাজেটে করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নেওয়া কর্মসূচিগুলোও চলমান থাকবে। সূত্রমতে, নতুন অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। যেহেতু দেশে করোনার ভ্যাকসিন ব্যাপক হারে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাই ধরা হচ্ছে করোনা মহামারীর পর চাঙা হয়ে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি। এতে করে সামনের বছর সরকারের আয় বাড়বে, যদিও এ বছর সরকারের আয় আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হলে আয় বাড়বে এমন ইতিবাচক ধারণা নিয়ে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বাজেটের খসড়া রূপরেখায়। তবে বাজেটে এসব ফিগার এখনো চূড়ান্ত নয়। শেষ মুহুর্তে এসব অঙ্ক বাড়তে-কমতে পারে।

রাজস্ব আয় : আসছে বাজেটে মোট ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা করছে সরকার। যদিও করোনার কারণে চলতি বছর কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় করতে পারেনি এনবিআর। করোনা-পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হলে আগামী বছর রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছে এনবিআর। এনবিআরের আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার। এনবিআর-বহিভর্‚ত রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো।

সোয়া ২ লাখ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন : আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের জন্য ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে সরকার, যা চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা বেশি। নতুন এডিপিতে সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে আসবে বাকি ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ১০টি বৃহৎ প্রকল্পে মোট ৫৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা পেয়েছে। এরপর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে (পিইডিপি) ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে মেট্রোরেল ৪ হাজার ৮০০ কোটি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ৩ হাজার ৮২৩ কোটি এবং পদ্মা সেতুতে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

করোনা বিবেচনায় বাড়বে ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি : করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে দরিদ্র ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হবে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি বাড়ানো হবে ভর্তুকিও। ভর্তুকি খাতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৪৮ কোটি এবং প্রণোদনায় ১০ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। আসছে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, আসন্ন বাজেটে (২০২১-২২) কৃষি খাতে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। ভর্তুকিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা। প্রাকৃতিক তরল গ্যাসে (এলএনজি) ভর্তুকি ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। রপ্তানি খাতে আগামী বছর ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া খাদ্যে ৬ হাজার কোটি, রেমিট্যান্সে ৪ হাজার কোটি, প্রণোদনা প্যাকেজ ঋণের সুদ পরিশোধে ২ হাজার কোটি টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ দিচ্ছে পাট খাতকে। এর বাইরে অন্য সব খাত মিলিয়ে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ। সূত্র জানান, আসন্ন বাজেটে কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় অগ্রাধিকার খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করাই হবে প্রধান অগ্রাধিকার। এজন্য স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যাণ, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় আগামী বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকছে। চলতি বাজেটেও এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।

ঘাটতি ছাড়াবে ২ লাখ কোটি টাকা : আসছে বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার মতো, যা মোট ডিজিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে আগামী বছরের মোট জিডিপি হতে পারে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মতো ব্যাংক ও অভ্যন্তরীণ খাত থেকে বেশির ভাগই ঋণ নিতে হবে সরকারকে। তবে করোনা মহামারীর কারণে এবার বিদেশি সহায়তা ও ঋণ বাড়বে বলে আশা করছে সরকার। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারের প্রেক্ষাপটটা একেবারেই ভিন্ন। অবশ্য গত বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে। এ মুহুর্তে মানুষের জীবনে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও কর্ম এ তিনটি সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাজেটে এসব বিষয়কেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর