শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

গেট বন্ধই প্রাণহানির কারণ

♦ বের হওয়ার শেষ চেষ্টা ছিল সবার, আগুন লাগার পর আবারও তালা দেওয়া হয় ♦ বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ হয়নি ভবনটি, কারখানায় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না

মাহবুব মমতাজী

মুহুর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ভবনটিতে। আতঙ্কে ছয়তলা ভবনটির চতুর্থ তলায় কলাপসিবল গেট লাগিয়ে পালিয়ে যান নিরাপত্তাকর্মী। আর চারতলার ওপরে শ্রমিকরা ভবনের ছাদে জড়ো হন। তৃতীয় তলা পর্যন্ত থাকা শ্রমিকরা আগুন লাগার পর বেরিয়ে আসার পথে দেখেন নিচের গেটটিও বন্ধ। বের হওয়ার শেষ চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে। উপায়ন্তর না পেয়ে ছাদসহ বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন অনেকে। এসব তথ্য জানা গেছে আহত কয়েকজন শ্রমিকের কাছ থেকে।

এদিকে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে দুটি স্থানে তালা বন্ধের চিহ্ন দেখে বিম্মিত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভবনটির গেট বন্ধ থাকাই এত প্রাণহানির কারণ। এমনকি কারখানায় ছিল না অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা। আর ভবন নির্মাণেও মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। ওই কারখানায় প্রচুর দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল, যে কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

গতকাল বিকাল পর্যন্ত ওই ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে ৪৯ জনের পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগের রাতে মারা যাওয়া তিনজনসহ নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে।

নিচ থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত বিভিন্ন তলায় আরও লাশ পাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, কারখানা থেকে আহত হয়ে ফিরে আসা বেশ কয়েকজন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তলাগুলোতে অন্তত তিন শর বেশি শ্রমিক ছিলেন। যাদের কেউ তালাবদ্ধ অবস্থায়, আবার কেউ আগুনের তীব্রতায় লাফিয়ে পড়তে গিয়ে মারা গেছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও মর্গ ঘুরে দেখা গেছে, ৫২ জন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার হয়েছে, অথচ আপনজনের খোঁজে শত শত স্বজন অপেক্ষা করছেন। ডিএনএ প্রোফাইলিং শেষ না হওয়ায় কোনো লাশ হস্তান্তর হয়নি। আগুন থেকে রক্ষায় ভবনের দোতলা থেকে লাফিয়ে আহত হালিমা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। তার মা শাহানা জানান, তার তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বড় মেয়ে সাদিয়া ও ছোট মেয়ে হালিমা একই কারখানায় কাজ করেন। বৃহস্পতিবার বিকাল চারটায় বড় মেয়ে সাদিয়া বের হওয়ার পরই ছোট মেয়ে হালিমা কাজে যোগ দেন। এর কিছুক্ষণ পরই একজন ফোনে আগুন লাগার খবর জানান। এরপর তারা রাতভর হালিমাকে খুঁজেছেন। কোথাও না পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে অচেতন অবস্থায় পান। 

বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন রায়হান আহমেদ। তিনি ওই কারখানায় কিউসি (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) ল্যাবের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। রায়হান বলেন, কারখানায় প্রবেশের আগেই ল্যাব। কাজ করার সময় হঠাৎ চিৎকার শুনতে পান তিনি। এরপর বের হয়ে দেখেন, ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। এরমধ্যে ওপর থেকে কয়েকজন লাফিয়ে পড়েন। কয়েকজন মিলে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে আনেন। তবে আগুন কীভাবে লেগেছে, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

আগুনের পর কারখানার একটি সিঁড়ি বন্ধ না থাকলে অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন।

তিনি বলেন, আমরা গাড়ির মই লাগিয়ে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, আমরা তাদের বাঁচাতে পারতাম। আর জরুরি বহির্গমন পথও বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বের হতে পারেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভবনের চতুর্থ তলায় ললিপপ ও তরল চকলেট, তৃতীয় তলায় অরগানিক পানীয় (জুস, লাচ্ছি), দোতলায় টোস্ট বিস্কুট ও বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং নিচতলায় বাক্স ও পলিথিন তৈরির কারখানা ছিল। পঞ্চম তলার একপাশে সেমাই, সেমাই ভাজার তেল ও পলিথিন এবং অপর পাশে কারখানার গুদাম ছিল। কারখানার ষষ্ঠ তলায় ছিল কার্টুনের গুদাম।

কারখানার সামনে অপেক্ষারত স্বজনদের ভাষ্য, নিখোঁজ শ্রমিকদের বেশির ভাগ কারখানা ভবনের চতুর্থ তলায় আটকে ছিলেন।

নিখোঁজ শ্রমিকের মা নাজমা বেগম জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে বাসা থেকে ভাত খেয়ে কারখানায় এসেছিল তার ছেলে রিপন। কিন্তু আগুন লাগার পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রিপনও ভবনের চতুর্থ তলায়ই কাজ করতেন।

কারখানার শ্রমিকরা জানান, প্রতি তলায় একটি করে সেকশন রয়েছে। সেখানে ঢোকা ও বের হওয়ার গেট রয়েছে। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা কাজ হয় কারখানায়। যখন শ্রমিকরা প্রবেশ করে এবং শিফট শেষে বের হয় তখন গেট খোলা হয়। নিচতলায় আগুন লাগলে সে খবর ওপরের তলাগুলোতে দেওয়াই হয়নি। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই আগুন গোটা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শ্রমিকরা বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আগুন লাগার পরও কর্তৃপক্ষ সেকশনের কলাপসিবল গেট বন্ধ রাখে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটির আয়তন প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট। ওই ভবনের জন্য অন্তত চার থেকে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা দরকার ছিল। ছিল মাত্র দুটি বের হওয়ার পথ। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল আগুনের মধ্যে। আগুনের শুরুতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর