সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ভোট ঘিরে নতুন জোটের চেষ্টা

বিএনপি ও জোটের একটি অংশের তৎপরতা । ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টায় হাইকমান্ড

মাহমুদ আজহার

ভোট ঘিরে নতুন জোটের চেষ্টা

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ‘মাইনাস’ করে নতুন জোটের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বিএনপির একটি অংশ ছাড়াও ২০-দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বেশ কয়েকটি দল রয়েছে। এ ছাড়াও সাবেক সামরিক-বেসরকারি আমলারাও এই তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন।

এরই মধ্যে জোট-ফ্রন্টের কয়েকটি দল বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করেছে। নতুন জোটের উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফায় অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে তারা জাতীয় সংসদে প্রয়োজনে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতেও আগ্রহী বলে জানা গেছে।

জানা যায়, এই গ্রুপের তৎপরতা সম্পর্কে অবগত বিএনপির হাইকমান্ড। দল ও দুই জোটের ঐক্য ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই ঐক্য প্রক্রিয়া ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জোট-ফ্রন্টসহ সরকারবিরোধী আরও বৃহত্তর প্ল্যাটফরম তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নতুন জোটের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সংবিধান ও আরপিও অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তারা সরকার গঠন না করতে পারলেও সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চান। সরকারের পক্ষ থেকেও সবুজ সংকেত তারা পেয়েছেন।

সংবিধানের ৬৯ অনুচ্ছেদের দফা (১) ও (২) অনুযায়ী, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাদের দায়ে কেউ যদি দুই বছরের জন্য দন্ডিত হন, তাহলে পরবর্তী পাঁচ বছর না যাওয়া পর্যন্ত তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় থেকেই বিএনপিকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। এমনকি বিএনপি ও জোট ভাঙতে এই সরকারও নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নানা অপচেষ্টা চালিয়েও বিএনপিকে সরকার ভাঙতে পারেনি। তিনি বলেন, সরকার নানামুখী তৎপরতা চালিয়েও জিয়া পরিবারের বাইরে নতুন কোনো প্ল্যাটফরম দাঁড় করাতে পারেনি, পারবেও না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ ও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সুসংগঠিত’।

তবে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, ‘নতুন একটি জোটের তৎপরতা সম্পর্কে আমি শুনেছি। আমরা ২০-দলীয় জোটেও আছি আবার জাতীয় মুক্তিমঞ্চেও আছি। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগামী নির্বাচনের জন্য আমরা দলগতভাবেও প্রস্তুতি নিচ্ছি। অনেকেই আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাচ্ছেন। নতুন জোটে কারা কীভাবে কাজ করছেন আমি জানি না।’

নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, বিএনপির মূলধারার বাইরে গিয়ে নতুন একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করতে চায় দলের একটি অংশ। বিএনপির এই অংশটিতে বিভিন্ন সময়ে দলে নানাভাবে বঞ্চিত, অবহেলিত ও হাইকমান্ডের মাধ্যমে অপমানিত গ্রুপটি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলের একাধিক প্রভাবশালী স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক এমনকি নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যায়ের নেতারা এই প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। এ ছাড়াও ২০-দলীয় জোটের বড় একটি অংশ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি অংশসহ সরকারবিরোধী অন্য দল-মতের নেতারাও থাকছেন নতুন এই প্ল্যাটফরমে।

বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী জিয়া পরিবারবিহীন কেউ মূল স্রোত থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন প্ল্যাটফরম দাঁড় করালেও কোনো লাভ হবে না। কোনো কিছু করতে হলে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ‘সবুজ সংকেত’ নিয়েই করতে হবে। তবে যে কোনো মূল্যে দলের মধ্যে ভাঙন ঠেকানোসহ ঐক্য ধরে রাখতে চান বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। দলের স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতারা একাধিকবার সাক্ষাৎ করতে গেলে বেগম জিয়াও সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। তাছাড়া লন্ডন থেকে দিনরাত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ফোনালাপে ঐক্য ধরে রাখা, দল গোছানোসহ নানা কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন তারেক রহমান। দলের মূলধারার নেতা-কর্মীরা জিয়া পরিবারের বাইরে কিছুই ভাবছেন না। 

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমরা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই বিএনপিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।’

জানা যায়, বিএনপির কয়েকজন নেতা ২০-দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে দেশের বাইরে একাধিক স্থানে বৈঠক করেছেন। সেখানে বসে তারা সরকারের মন্ত্রিসভাও তৈরি করেন। কে কোন মন্ত্রণালয়ে থাকবেন সেই তালিকাও তারা তৈরি করেন। পরবর্তীতে রাজধানীতে কয়েক দফা শোডাউনও দেন। বিষয়টি জেনে যায় বিএনপির হাইকমান্ড। দলের শীর্ষ নেতাদের ধারণা, এই গ্রুপটি সরকারের যোগসাজশেই নতুন প্ল্যাটফরম তৈরি করতে চাচ্ছে। তারা বিএনপি থেকে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করতে যান। সরকার একটি দুর্বল বিএনপিকে নিয়ে আগামী নির্বাচনে যাবে। সেই নির্বাচনে এই গ্রুপটিকেই বিরোধী দলের ভূমিকায় রাখা হবে। দেশ-বিদেশে জানান দেওয়া হবে, বাংলাদেশের সংসদ কার্যকর। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলও আছে।

জানা যায়, বিএনপির এই অংশের নেতাদের সঙ্গে তারেক রহমান একাধিকবার কথা বলেছেন। তাদের এ প্রক্রিয়ায় জড়িত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। জিয়া পরিবারের সঙ্গে থেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরপর কেউ কেউ ফিরে এলেও একটি অংশ এখনো নতুন প্ল্যাটফরম গঠনে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। যত বাধা-বিপদ বা দুঃসময়ই সামনে আসুক না কেন, জিয়া পরিবারই আমাদের সামনের পথ চলার মূল শক্তি।’

পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও সাবেক ছাত্রনেতা ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাই বিএনপির প্রাণশক্তি। ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন দুঃসময়ে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। দলের দুই-চারজন নেতা যদি নিজেদের সুবিধার্থে মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে কিছু করার কথা ভাবেনও তাতেও বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না। তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।’

বিএনপির একটি সূত্র এও জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নতুন রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিএনপির নিষ্ক্রিয়, পদবঞ্চিত ও পদত্যাগকারী কিছু নেতা রয়েছেন। এতে সাবেক কিছু সামরিক-বেসামরিক আমলাও রয়েছেন। ২০-দলীয় জোটের জামায়াতে ইসলামী, কল্যাণ পার্টিসহ কয়েকটি দল, গণফোরামের একটি অংশ এবং বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কয়েকটি দল রয়েছে। এ ছাড়া এর সঙ্গে বেশ কয়েকটি বাম-ডান ও ইসলামী ঘরানার দলও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত। নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন দলের নেতারা ইতিমধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। খুব শিগগিরই আবারও তারা বৈঠকে মিলিত হবেন। 

তবে বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, অলি আহমদ সে ধরনের সংগঠক নন, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও নেই। বিএনপি নেতা-কর্মীরা এতটাই দেউলিয়া হয়ে যাননি যে অলি আহমদের নেতৃত্বে নতুন প্ল্যাটফরম গড়ে তুলতে হবে।

এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘অলি আহমদ অতিরিক্ত উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে তিনি এখন না ঘড়কা না ঘাটকা। তার সঙ্গে যারা এলডিপি গঠন করেন তাদের মধ্যে ড. রেদওয়ান আহমেদ ছাড়া কেউ নেই। কিছু সাবেক সেনা কর্মকর্তা হয়তো তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কিন্তু বিএনপি বা অন্য কোনো দলের কেউ তার সঙ্গে যাবে-এটা বিশ্বাস করা যায় না। কারণ তার সঙ্গে প্রথম দিন যিনি কথা বলেন, দ্বিতীয় দিন কথা বলতে চান না। তার মধ্যে প্রচ- আত্ম-অহমিকা ও আত্মকেন্দ্রিকতা কাজ করে।

এদিকে গত ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (একাংশ)। ওই অংশের নেতারা এর কারণ হিসেবে জানান, জোটের শরিক দলের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই উপনির্বাচন এককভাবে বর্জন করা, আলেমদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ না করা, প্রয়াত জমিয়ত মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমীর মৃত্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে সমবেদনা না জানানো এবং তার জানাজায় শরিক না হওয়া। জানা যায়, নানামুখী চাপ আর লোভে আরও কয়েকটি ছোট ছোট দল বিএনপি জোট ছাড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘রাজনীতি হলো ভাঙাগড়ার খেলা। রাজনৈতিক চাপে, মামলা মোকদ্দমার প্রচ- রকমের চাপে ছিল জমিয়ত। তারা রাজনীতিতে টিকতে পারছে না। আমাদের সঙ্গে তাদের কখনো কোনো সমস্যা হয়নি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জমিয়ত নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে জোট ছেড়েছেন।’

সর্বশেষ খবর