বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

লোথাল থেকে হর্সশু টেবিল : ভারতের সামুদ্রিক যাত্রা

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা

লোথাল থেকে হর্সশু টেবিল : ভারতের সামুদ্রিক যাত্রা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি-ইউনাইটেড নেশন্স সিকিউরিটি কাউন্সিল) ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত ‘সামুদ্রিক নিরাপত্তা বর্ধিতকরণ : আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি বিষয়’ শীর্ষক বিতর্ক সভায় সভাপতিত্ব করলেন। একাধিক কারণে এটা এক ঐতিহাসিক প্রথম ঘটনা।

প্রথমত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম ইউএনএসসির সভায় সভাপতিত্ব করেছেন। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচ্যসূচি হিসেবেও বিষয়টি এবারই প্রথম আলোচিত হলো। সাগরে দস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতি বিষয়ে অতীতে পরিষদে আলোচনা হলেও এবারই সেখানে নিরাপত্তার ওপর বিশদ আলোচনা হয়। লক্ষণীয় যে ভারতই এ সভার উদ্যোক্তা। এ সভায় পরিষদ এবারই সর্বপ্রথম ‘সামুদ্রিক নিরাপত্তার ওপর সভাপতির বিবৃতি’  গ্রহণ করে যা পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের সবাই সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করল।

ইউএনএসসির সভাপতির বিবৃতিতে সমুদ্র আইনসংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশনে বিবৃত আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত হয়েছে। এতে সন্ত্রাসবাদীদের সাগর ব্যবহারের মাধ্যমে আক্রমণ, যেমনটি হানা হয়েছিল ২৬/১১ মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার সময়, প্রতিহত করতে সক্ষমতা তৈরির এবং ওই অপরাধ মোকাবিলায় ফলপ্রসূ অনুশীলনের তাগিদ দেওয়া হয়। সাগরে সংঘবদ্ধ যেসব অপরাধ ঘটানো হচ্ছে তার উল্লেখ করে বিবৃতিতে সাগরের বৈধ ব্যবহারকারীদের এবং সাগরভিত্তিক ও উপকূলীয় এলাকাভিত্তিক জীবিকা নির্বাহকদের সুরক্ষাবিধানের ওপর জোর দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ছিলেন নিরাপত্তা পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি, চারজন রাষ্ট্র/সরকার প্রধান ও ১০ জন মন্ত্রী। এতে ভারতের আন্তর্জাতিক আর প্রধানমন্ত্রীর বৈশ্বিক মর্যাদার প্রতিফলন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর বক্তব্যে সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার ব্যাপারে পাঁচটি নীতি অবলম্বনের প্রস্তাব করেন। এগুলোয় আছে : সমুদ্রে বৈধ বাণিজ্যের পথের বাধাগুলো দূরীকরণ; আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে সামুদ্রিক বিরোধগুলো শান্তিপূর্ণভাবে নিরসন করা; প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামুদ্রিক হুমকি যৌথভাবে মোকাবিলা করা; সামুদ্রিক সম্পদ ও প্রতিবেশের সুরক্ষাবিধান এবং দায়িত্বশীল সামুদ্রিক সংযুক্তির বিকাশ সাধন।

এ পাঁচ নীতি হচ্ছে সামুদ্রিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি বিষয়ে ভারতের ঘোষিত অবস্থানের সম্প্রসারণ। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ‘সাগর’ ধারণা তুলে ধরেছিলেন। সাগর মানে ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন’। এরপর তিনি ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে দিলেন ‘সানগ্রি-লা সংলাপ’ ভাষণ যে ভাষণে তিনি ভারতের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন’-এর রূপরেখা বর্ণনা করেন। ২০১৯ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত পূর্ব এশিয়া শীর্ষ বৈঠকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান্স ইনিশিয়েটিভ’-এর সূচনা করেন। সেখানে তিনি সমুদ্রসংলগ্নতানির্ভর দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার জন্য সাতটি স্তম্ভ গড়ার প্রস্তাব দেন।

সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকা আর ১ হাজার ২০০ দ্বীপবিশিষ্ট দেশ ভারত। সাগর সব সময়ই তার কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। ভারতের রয়েছে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক ইতিহাস যার সূচনা ন্যূনপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে; তখন সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার লোকজন মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য করেছে। গুজরাটের লোথাল নামক স্থানে ছিল বিশ্বের প্রথম ডক (জাহাজ তৈরি ও মেরামত কেন্দ্র) যার প্রত্ননিদর্শন বলছে, এখান থেকে ভারত মহাসাগরে ও তারও বাইরে নিরাপত্তাবিধানের ব্যবস্থা করা হতো যার মধ্যে ছিল মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগকালে ত্রাণও। সাগরদূষণ নিয়ন্ত্রণ একটি নতুন বিষয় যার জন্য শ্রীলঙ্কা ও মরিশাস আহ্বান জানালে ভারত সাড়া দিয়েছিল।

ইউএনএসসির সোমবারের বিতর্ক সভায় বেশ কজন বক্তা তাদের বক্তৃতায় বলেন, এতকাল ধরে পরিষদের বিবেচনার বাইরে থাকা একটি বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করল ভারত; এটা তার তাৎপর্যময় এক সাফল্য। অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ সফলতা না পাওয়ার কারণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পূর্ব-ধারণা। সোমবারের বিতর্কে ভ্রান্তিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে যায়। পরিষদ ঐকমত্যের ভিত্তিতে সভাপতির বিবৃতির আকারে একটি দলিলও প্রণয়ন করেছে। ভারতের বৈশ্বিক মর্যাদা তার গঠনমূলক সেতুবন্ধ রচনার ফলেই সম্ভব হয়েছে। এতে প্রমাণ হলো যে বৈশ্বিক কঠিন সমস্যাবলির প্রতিকারের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।

এই ‘প্রেসিডেন্সি ওপেন ডিবেট’ সফলভাবে আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে দায়িত্বশীল কুশীলব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল ভারত। ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিষদ সভায় ইতিবাচক ফল বেরিয়ে আসায় আমাদের বিশ্বাসটা জোরদার হয়েছে। বিশ্বাসটা হলো : সমসাময়িক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়ে, পুনর্গঠিত ইউএনএসসির মাধ্যমে বহুসংখ্যক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তার সমাধান করা যায়। এবং সেটা করা যায় স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতবিখ্যাত হর্সশু টেবিলে (নিরাপত্তা পরিষদের অশ্বখুরাকৃতি টেবিল) ভারতের ন্যায়সংগত আসন গ্রহণের মাধ্যমেই।

লেখক : ভারতের পররাষ্ট্র সচিব।

সর্বশেষ খবর