শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগের খুনোখুনি

অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এক মাসে নিহত ৮ ॥ চলমান ইউপি-পৌর নির্বাচন ঘিরে ১৭৭ সংঘর্ষে ৩৮ জন নিহত, আহত ২ হাজারের বেশি

রফিকুল ইসলাম রনি

ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগের খুনোখুনি

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে মাঠে নেই বিএনপি। অধিকাংশ ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। সাধারণ সদস্য (মেম্বার) পদে দলীয় প্রতীক না থাকলেও এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখার লড়াইয়ে রক্ত ঝরাচ্ছেন নিজ দলের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এক মাসে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ক্ষমতাসীন দলের আট নেতা-কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন। আর জানুয়ারি থেকে প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, মেয়াদোত্তীর্ণ উপজেলার ভোটে এ পর্যন্ত ১৭৭টি সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের ৩৮ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। বিএনপিবিহীন ভোটে আওয়ামী লীগ যেন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। এ নিয়ে কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এমনকি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে চলেছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ‘অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী সহিংসতা’র শঙ্কা ততই বাড়ছে।

দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়নে ১১ নভেম্বর এবং তৃতীয় ধাপের ১ হাজার ৭টি ইউনিয়নে ২৮ নভেম্বর নির্বাচন। ইতিমধ্যে এ দুটি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। তবে স্থানীয় এমপি ও জেলা নেতাদের ইচ্ছায় শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে দুটি জেলায় দলীয় প্রার্থী দেওয়া হয়নি। সেখানে উন্মুক্ত ভোট হবে। প্রথম ধাপে ২১ জুন ২০৪টি ইউপি ও ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইউপি নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিরোধ মেটাতে কেন্দ্র থেকে বারবার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা অব্যাহত আছে। দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য বারবার নির্দেশ দিচ্ছেন। চেষ্টার কমতি নেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদেরও। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। কঠোর হুঁশিয়ারির পরও থামেনি কোন্দল।

কোন্দলের কারণে খুনোখুনি বাড়ছে- এটা মানতে নারাজ দলটির নীতিনির্ধারক ফোরামের একাধিক নেতা। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘সব ঘটনা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ নয়। স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আধিপত্য ধরে রাখার প্রবণতা, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের কারণেও এসব ঘটছে। তবে দলে বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়ে কঠোর। যারাই বিশৃঙ্খলা করবে তাদের কাউকে বরদাশত করা হবে না।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে দলকে ভবিষ্যতে বেকায়দায় ফেলতে প্রতিপক্ষ কোনো দলের প্রয়োজন হবে না। ইদানীং ভাগাভাগির দৌড়ে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টরা এতটাই বেপরোয়া যে ‘ধরো, মারো, কাটো, তবু নিজের স্বার্থ হাসিল কর’। ‘দল গোল্লায় যাক। আগে নিজের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতে হবে’। যে কারণে চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, মেম্বার হতে হবে অথবা এলাকায় আধিপত্য লাগবে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আওয়ামী লীগসহ দলটির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াচ্ছেন। মাঝেমধ্যে লাশ পড়ছে। দল ক্ষমতায় থাকতেও রক্ত ঝরছে নিজ দলের কর্মীর হাতে। সন্তান হারাচ্ছেন কেউ কেউ। নির্বাচনী সহিংসতায় বৃহস্পতিবার আধিপত্য বিস্তার ও ইউপি নির্বাচন কেন্দ্র করে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার কাচারিকান্দি গ্রামে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন নিহত ও কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন কাচারিকান্দি গ্রামের মারফত আলীর ছেলে সাদির মিয়া ও একই গ্রামের আসাদ মিয়ার ছেলে হিরণ। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহতরা হলেন- রমজান, মোকলেস, আহিদ মিয়া, জজ মিয়া, শামসুন্নাহার, দানা মিয়া, আলামিন মিয়া। টেঁটাবিদ্ধ হয়ে আহতরা হলেন- নাজির, নাজমা, দানিস মিয়া, মো. হক মিয়া। এরা সবাই কাচারিকান্দি গ্রামের ছোট শাহ আলমের সমর্থক। এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কাচারিকান্দি গ্রামে শাহ আলম মেম্বার ও ছোট শাহ আলমের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। দ্বন্দ্বের জেরে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। প্রতিপক্ষের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছোট শাহ আলম গ্রুপের সাদির (২২) ও হিরণ (৩৫) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ১৫ অক্টোবর মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নের দক্ষিণ জগদল গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতায় চারজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- ওই গ্রামের সাহাবাজ মোল্যার ছেলে সবুর মোল্যা, কবির হোসেন, চাচাতো ভাই রহমান মোল্যা ও ইমরান। এ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি মেম্বার নজরুল হোসেন। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে তফসিল ঘোষণার পর এ ওয়ার্ড থেকে সৈয়দ আলি নামে অন্য একজন মেম্বার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন। এ ঘটনার পর থেকেই কয়েকদিন ধরে এলাকায় নজরুল মেম্বার ও সৈয়দ আলি সমর্থিতদের মধ্যে বাদ বিবাদ চলছিল। তারই ধারাবাহিকতায় নজরুল মেম্বার সমর্থিতরা সৈয়দ আলি সমর্থিতদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান। এতে অন্তত ১০ জন গুরুতর আহত হলে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনজনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইমরানের মৃত্যু হয়।

১৭ অক্টোবর কাপ্তাই উপজেলার সদর ইউনিয়নের প্রতিবেশী চিৎমরম ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে নিজ বাসায় গুলি করে হত্যা করে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত। ওই ঘটনার পর এ ইউনিয়নের নির্বাচন পিছিয়ে ২৮ নভেম্বর নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। ২৬ অক্টোবর রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। আহত হন আরও তিনজন। নিহত সজীবুর রহমান ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের জেলা কমিটির সদস্য। নিহত সজীব আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল লতিফের সমর্থক। এখানে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মহিউদ্দিন পাটোয়ারী বাদলও চেয়ারম্যান প্রার্থী। ২৭ অক্টোবর ঢাকার ধামরাইয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রচারণার প্রথম দিনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে চার ইউনিয়নে গুলি ছোড়া, মারধর ও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ করেছেন বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বিকালের দিকে বালিয়া ইউনিয়নে মুখোমুখি দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজনের হাত ভেঙে যায়। এ ছাড়া মাগরিব নামাজের পরপর সোমভাগ ইউনিয়নে মারধরের শিকার হন প্রার্থীসহ চারজন। সন্ধ্যার দিকে গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নে পোস্টার লাগাতে গিয়ে মারধরের শিকার হন আরেকজন। ২৩ অক্টোবর ফরিদপুরের সালথার আওয়ামী যদুনন্দী ইউনিয়নের খারদিয়া গ্রামে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে মারিজ সিকদার (৩০) নামের একজন নিহত হন। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। ২৪ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক আলাউদ্দিন ওরফে আলাল (৪৫) প্রতিপক্ষের আঘাতে নিহত হন। প্রথম ধাপের ভোটে ২০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালীতে ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলিতে একজন নিহত হন। প্রায় একই সময়ে কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ ইউনিয়নের সিলটকাটায় দুই পক্ষের প্রার্থীর সমর্থকদের সহিংসতায় নিহত হন একজন। উভয় ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত আরও ১০ জন। আর বরিশালের গৌরনদীতে নিহত হন দুজন। বুধবার রাতে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নসহ কয়েকটি স্থানে সহিংসতা ঘটে। আহত হন পাঁচজন। তারা স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মোল্লা মাবুবুর রহমানের সমর্থক। নৌকার প্রার্থী কুদ্দুসের ভাই শেখ হায়দার আলীর নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ উপজেলায় মাগুরখালী ইউনিয়নের গজালিয়া গ্রামে নৌকার প্রার্থীর এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে। পাবনার সুজানগরে বৃহস্পতিবার রাতে হাটখালী ইউনিয়নের বারভাগিয়া গ্রামে আওয়ামী লীগ ও দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলি, নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হন। আহতের মধ্যে দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পাবনা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহতরা হলেন- আজাহার আলী মোল্লা (৬৫), আজগর আলী মোল্লা (৬০), খাইরুল ইসলাম (৪০), রেহেনা খাতুন (৩৫) জুবায়ের হোসেন প্রমুখ। বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজারের চকরিয়ায় বিএমচর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের নির্বাচনী কার্যালয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে দুই পক্ষের নয় সমর্থক আহত হন। বৃহস্পতিবার রাতে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আলীনগরের বর্তমান ইউপি চেয়াম্যান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হাফিজুর রহমান মিলন সরদারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর, প্রাইভেট কারসহ ১০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও সমর্থক রাজারচর গ্রামের খগেন মন্ডলের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাহীদ পারভেজের সমর্থকরা। অন্যদিকে একই দিনে দুপুরে শিকারমঙ্গল ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মালের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুরসহ সমর্থকদের মারধর করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সিরাজুল আলম মৃধার সমর্থকরা। একই ভাবে কয়ারিয়া ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কামরুল হাসান নূর মোহাম্মদ মোল্লার চাচা শামীম মোল্লা পরিবার-পরিজন নিয়ে ইউপি কার্যালয়ে করোনাভাইরাসের টিকা দিতে এলে তার ওপর হামলা চালান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জাকির হোসেন জমাদারের সমর্থকরা।

১০ জনকে কুপিয়ে জখম : পটুয়াখালী সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ছোট ভাই পৌর কাউন্সিলরের নেতৃত্বে তাদের কর্মীরা। এতে বিদ্রোহী আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. জুয়েল মৃধাসহ ১০ জন আহত হয়েছেন।

 শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নের লোহালিয়া খেয়াঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

(আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের সহায়তায় প্রতিবেদন তৈরি)

সর্বশেষ খবর