রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা অপরিবর্তিত। বিএনপি নেতারা বলছেন, অবস্থা সংকটাপন্ন।
খালেদা জিয়াকে নিয়ে কোনো ধরনের গুজবে কান না দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একই অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কোনো গুজবে কান দেবেন না। তাঁর বিষয়ে কোনো তথ্য জানতে চাইলে আমাকে ফোন করবেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ খালেদা জিয়াকে দেখে এসে বলেন, ‘তিনি কতক্ষণ, কয় মিনিট, কয়দিন বাঁচবেন তা আমি বলতে পারব না। যে কোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারেন।’
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার দাবিতে আট দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর মধ্যে রয়েছে- রোগমুক্তি কামনায় দোয়া, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মৌনমিছিল। এ ছাড়া একই দাবিতে গতকাল সারা দেশের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এভারকেয়ার হাসপাতালের হেড অব মার্কেটিং জামিল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে নিয়ে যা শোনা যাচ্ছে সবই গুজব। তাঁর অবস্থা অপরিবর্তিত আছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।’ বমি করা বা খাবার খেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তাঁর চিকিৎসক বলতে পারবেন। তাঁর জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি বমি করেছেন এবং বমির সঙ্গে সামান্য রক্ত গেছে। তাঁকে তরল খাবার দেওয়া হয়েছে।
এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে নিয়ে সোমবার রাত থেকে নানা ধরনের গুজব ছড়াতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব গুজব ছড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও নানা উদ্বেগ দেখা দেয়। পরে চিকিৎসক ও বিএনপি নেতারা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে যেসব কথা ছড়ানো হচ্ছে সবই গুজব। খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের কেউ নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, সোমবার রাত থেকেই খালেদা জিয়া খুব বেশি দুর্বল হতে থাকেন। তাঁর শরীরে হরমোনাল অসমতা চরম আকার ধারণ করে। প্রধান ইলেকট্রোলাইট অর্থাৎ সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ক্লোরিন উপাদানের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এ দুর্বলতা। চিকিৎসকের ভাষায় ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। মাঝখানে এটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সোমবার রাত থেকে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। কিডনির ক্রিয়েটিনিন বর্ডার লাইন অতিক্রম করেছে। খাওয়া-দাওয়ার রুচিও কম। ডায়াবেটিস ১২-১৩-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। হাসপাতালসূত্র জানান, খালেদা জিয়ার গলার দিকে সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার লাইন লাগানো আছে, যা চিকিৎসকের ভাষায় বলা হয় সিভি লাইন। রোগীর মাল্টিপল ডিজিজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেই এটি সংযুক্ত করা হয়। সিভি লাইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় রক্তনালি সংযুক্ত করা হয়। এর তিন-চারটি চ্যানেল রয়েছে যার দ্বারা একসঙ্গে সব ধরনের ওষুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত একজন চিকিৎসক জানান, শারীরিক দুর্বলতার মধ্যেই মঙ্গলবার রাতে তাঁর রক্তবমিসহ শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এতে তাঁর রক্তের হিমোগ্লোবিন মাত্রাতিরিক্ত কমে যেতে শুরু করে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে দ্রুত রক্ত দিতে চাইলেও শারীরিক দুর্বলতার কারণে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার অবস্থা দ্রুতই অবনতি ঘটতে থাকলে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সোমবার রাত ১০টার দিকে তাঁর শরীরে রক্ত দিতে সক্ষম হন তাঁরা।
গতকাল এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখতে যান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি। মেডিকেল বোর্ডের ছয়জন চিকিৎসক আমাকে বিস্তারিত বলেছেন। আমি তাঁদের ফাইলের প্রতিটি লেখা পড়ে দেখেছি। উনার মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। ব্লাড প্রেসার ১০০-এর নিচে নেমে এসেছে। সম্ভব হলে আজকে (বুধবার) রাতেই উনাকে বিদেশে ফ্লাই করানো উচিত। আর না হলে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এখনো তিনি সংকটাপন্ন অবস্থাতেই আছেন। ডাক্তার সাহেবরা মনিটর করছেন, তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের পক্ষে যা সম্ভব তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তাঁরা করছেন।’
আট দিনের কর্মসূচি বিএনপির : খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাঁর বিদেশে চিকিৎসা নিতে সুযোগ দেওয়ার দাবিতে আট দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এসব কর্মসূচি বিএনপিসহ দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে পালন করা হবে।
গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কর্মসূচি ঘোষণা করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলে, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলো আমরা আলোচনা করেছি। ২৫ নভেম্বর যুবদল ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে, ২৬ তারিখে বাদ জুমা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও রোগমুক্তির জন্য দোয়া চাওয়া হবে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের যারা আছেন তারা নিজস্ব উপাসনালয়ে প্রার্থনা করবেন। ২৮ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ করবে, ৩০ তারিখে বিভাগীয় সদরগুলোয় বিএনপির উদ্যোগে সমাবেশ হবে। ১ ডিসেম্বর ছাত্রদল সারা দেশে সমাবেশ করবে, ২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবে, ৩ ডিসেম্বর কৃষক দল ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশ করবে এবং ৪ তারিখে মহিলা দল মৌনমিছিল করবে।’ মহাসচিব আরও বলেন, ‘কর্মসূচি পালন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার ওপর। প্রয়োজনে কর্মসূচি পরিবর্তনও হতে পারে। সেটা সময়মতো আমরা জানাব।’ এর আগে দলটির যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে যৌথ সভা করেন মির্জা ফখরুল। সূত্র জানান, সভায় নেতাদের উদ্দেশে বলা হয়- শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। যে কোনো উসকানি বা স্যাবোটাজ যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে তৃণমূল নেতান্ডকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বলা হয়। বিএনপি মহাসচিব বলেন, খালেদা জিয়া এখন যে অবস্থায় আছেন তাঁকে সরকার এ মুহূর্তেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে পারে। সমস্ত ক্ষমতা সরকারের। এজন্য সমস্ত দায় সরকারের।
জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি : কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলামের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, খালেদা জিয়া মিথ্যা মামলায় তিন বছর ধরে বন্দী। এর মধ্যেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে তিলে তিলে নিঃশেষ করতেই বন্দী করা হয়েছে। এর প্রমাণ হলো তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছেন। খালেদা জিয়ার দ্রুত মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে ঢাকা জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে এ স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এ সময় বিএনপির ঢাকা জেলা সভাপতি দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু আশফাক, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আড়াই হাজার সাংবাদিকের আহ্বান : খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ২ হাজার ৫৮২ জন সাংবাদিক। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান তারা। বিবৃতিতে তারা বলেন- খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দেশে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো আর কিছু বাকি নেই। তাই আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক দিক বিবেচনা করে তাঁকে অবিলম্বে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন- জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, দৈনিক নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, বাসসের সাবেক প্রধান সম্পাদক আমানউল্লাহ, দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, দৈনিক দিনকাল সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, দ্য নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, কবি ও সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার, কবি ও সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ, বিএফইউজে মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ডিইউজে একাংশের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, বিএফইউজের সহকারী মহাসচিব শফিউল আলম দোলন, সিনিয়র সাংবাদিক লোটন একরাম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী প্রমুখ। ৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে ১২ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তির পর টানা ২৬ দিন চিকিৎসা নিয়ে ৭ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন তিনি। ২৫ অক্টোবর বিএনপি-প্রধানের একটি অস্ত্রোপচার ও বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়। তাঁর বায়োপসি রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ শনাক্ত করা যায়নি। তবে কেউ কেউ বলছেন তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত। এর আগে ২৭ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে করোনা সংক্রমণ নিয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। করোনা-পরবর্তী জটিলতা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য তিনি ১৯ জুন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছিলেন।