শুক্রবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিরোধ নয়

উবায়দুল্লাহ বাদল

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিরোধ নয়

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাজ করার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও ডিসিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।’ আর স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ না হওয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

সম্মেলনের শেষ দিনে গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ বিষয়ে ডিসিদের আরও সংবেদনশীল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়াসহ ডিসি-এসপিদের এক হয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি বন্ধে ডিসিদের সহযোগিতা চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ ‘গুজব’ ছড়ালে বা ‘অপপ্রচার’ চালালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভূমিসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে দেশে বসবাসরত নাগরিকদের ক্ষেত্রে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। নদীর নাব্য রক্ষা, দূষণ ও দখল রোধ, অবৈধ বালু ওঠানো বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘ওমিক্রন’ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ বিয়ের অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার পরামর্শও এসেছে। সম্মেলনের সমাপনী দিনের বিভিন্ন কর্ম-অধিবেশনে ডিসিদের বিভিন্ন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

সম্মেলনের সমাপনী দিনে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সরকারের ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্য-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে এসব অধিবেশনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব ও দফতরপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তাঁরা ডিসিদের পাঠানো প্রস্তাবসহ বিভিন্ন বিষয় মনোযোগসহকারে শোনেন এবং ডিসিদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। সম্মেলনের মূল ফোকাস কী- জানতে চাইলে প্রায় অভিন্ন ভাষায় একাধিক ডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারের সম্মেলনের প্রধান ফোকাসই ছিল জনবান্ধব প্রশাসন নিশ্চিত করা। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে জনগণের মনোনীত প্রতিনিধির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার বিষয়ে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সব ধরনের ভয়ভীতি ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করতে। সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আপনাদের পক্ষে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে। এতে সাধারণ মানুষ হবে উপকৃত। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সেবা নিতে এসে কোনো মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন। শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে সোচ্চার হতে হবে।’ এমনকি একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী তাঁদের কর্ম-অধিবেশনেও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রশাসন পরিচালনার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজের নির্দেশ : জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। নিজ মন্ত্রণালয়ের অধিবেশন শেষে তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সংসদ সদস্যরা বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন কিংবা অন্য সরকারি অফিস অনেক সময় প্রত্যাশিত সম্মান দেয় না। তাদের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয় না। এটি খুবই দুঃখজনক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ হয় না। এজন্যই এ নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন যেগুলো নিজেরাই করতে পারে, সেগুলো অনেক সময় ঢাকায় পাঠিয়ে দেয় এবং নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। এর ফলে সবাই ঢাকাকেন্দ্রিক হচ্ছেন। এ বিষয়েও সজাগ হতে ডিসিদের বলা হয়েছে।’ এ ছাড়া প্রবাসীদের হয়রানিমুক্ত সেবা দিতেও নির্দেশ দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

ডিসি-এসপিদের একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে ডিসিদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডিসি-এসপি যারা এ প্রশাসনের কাজে নিয়োজিত, সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করবেন- এটাই ছিল আজকের মূল কথা। ডিসি সম্মেলনের অধিবেশন শেষে তিনি এ কথা বলেন। দন্ডবিধির ২২৮ ধারা মোবাইল কোর্ট তফসিলে যুক্ত করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে কোনো আলোচনা আজ হয়নি। হয়তো ক্যাবিনেট সচিব আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। এ নিয়ে ক্যাবিনেট সচিব ও আইন সচিব মিলে কিছু একটা করবেন। তিনি আরও বলেন, র‌্যাবকে যারা তৈরি করেছিলেন, এখন তারাই র‌্যাবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন।

বেসামরিক-সামরিক প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে : দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। এর বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অসামরিক প্রশাসনের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি নিজেই এখানে এসেছি এটা ইন্ডিকেট করে আমরা এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা সোনার বাংলা গড়ার যে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়েছি, সেখানে সামরিক-অসামরিক প্রশাসন একসঙ্গে কাজ না করলে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। সবাই একমত হয়েছি যে আমাদের একসঙ্গে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো কাজ একসঙ্গে করার জন্য পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভালো পরিবেশের জন্য ভালো সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। যত যোগাযোগ হবে তত গ্যাপ কমবে। কমিউনিকেশন গ্যাপ যত কম হবে তত আমাদের কাজ করা সহজ হবে।’

কোথায় দুর্নীতির সুযোগ জানেন ডিসিরা : দুর্নীতি দমনে ডিসিদের সহযোগিতা চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ বলেছেন, একজন ডিসি জানেন তার অফিসে কোথায় কোথায় দুর্নীতির সুযোগ আছে। নিজ কর্ম-অধিবেশন শেষে তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, কমিশনের একটি কাজ হলো সচেতনতা বৃদ্ধি। দুর্নীতি যেন না হয়, দুর্নীতি থেকে যেন মানুষ দূরে থাকে তা দেখাও দুদকের কাজ। এজন্য আমরা ডিসিদের অনুরোধ জানিয়েছি, তারা যেন আমাদের সব সময় সাহায্য করেন। কোথায় নতুন রূপে দুর্নীতি হচ্ছে এবং কীভাবে তা বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে তারা যেন সহযোগিতা করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি এমন একটি জিনিস, প্রমাণ পাওয়াটা খুব কঠিন। অকাট্য প্রমাণ ছাড়া তো আমরা এগোতে পারি না। কারণ এটা না হলে আদালত মামলা গ্রহণ করবে না। যিনি ঘুষ নেন ও যিনি দেন তারা কেউ তো স্বীকার করে না। এটি কমিয়ে আনতে আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের যারা অনুসন্ধান করেন, তাদেরও আমরা জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ ‘গুজব’ ছড়ালে বা ‘অপপ্রচার’ চালালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। নিজ মন্ত্রণালয়ের অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া অপপ্রচারের একটি বড় ক্ষেত্র। গত আট বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, গুজব রটেছে, রটানো হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, সেগুলোর প্রায় সবই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে করা হয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় নানা বিভ্রান্তিমূলক খবর পরিবেশন করে সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিষয়ে ডিসিরা যেন তৎপর হয়ে ব্যবস্থা নেন সে নির্দেশনা দিয়েছি। এ ছাড়া সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী আইপি টিভি বা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে খবর প্রচার করতে পারে না। কিন্তু এখনো কোনো কোনো জায়গায় আইপি টিভি ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে সংবাদ প্রচার হচ্ছে। ডিসিদের বলেছি, তারা যেন এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেন।

স্বাস্থ্যবিধি না মানলেই ব্যবস্থা : করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। সম্মেলনের শেষ দিনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ডিসিদের বলেছি, আপনারা গতবার যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করেছেন এবারও তা করতে হবে। ওমিক্রনের কারণে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ১১ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এগুলো বাস্তবায়নের মূল হাতিয়ার জেলা প্রশাসন। বাসে, ট্রেনে, স্টিমারে যখন লোক চলবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে; সামাজিক দূরত্ব যতটুকু সম্ভব মানতে হবে। বিয়ের অনুষ্ঠানসহ সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। এ বিষয়গুলো আমরা তুলে ধরেছি।

বন্ধ হচ্ছে ভূমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি : ভূমিসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে দেশে বসবাসরত নাগরিকদের ক্ষেত্রে আগামীতে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ ক্ষমতা ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অপব্যবহার হচ্ছে। আমি স্ট্রেট বলে দিয়েছি, যারা প্রবাসে থাকেন, তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এলিজেবল। কিন্তু যারা দেশে আছেন তারা নো মোর পাওয়ার অ্যাটর্নি। তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, নামজারি শতভাগ না হলেও শতভাগের কাছাকাছি আমরা অনলাইন করেছি। ভূমি উন্নয়ন কর ম্যানুয়ালিও আমরা চালাচ্ছি। এ বছরের মধ্যে যদি ডেটা এন্ট্রি শেষ হয় তাহলে বছরের শেষ দিকে ম্যানুয়ালি ভূমি উন্নয়ন কর সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেব। মন্ত্রী আরও বলেন, সাব-রেজিস্ট্রাররা ভূমির কাজ করেন, অথচ তারা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন। ভূমি ব্যবস্থাপনার কাজে সমন্বয় করাটা জটিল হয়। এটি আমার একটি কষ্টের জায়গা। কী কারণে কেন এটা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়া হলো তা আমার বোধগম্য নয়। সাব-রেজিস্ট্রাররা আশা করি ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় চলে আসবেন। তবে না এলেও কোনো সমস্যা হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর