মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

শোকে স্তব্ধ সীতাকুণ্ড বাতাসে পোড়া গন্ধ

♦ নিহত ২৬ জনের পরিচয় মিলেছে ♦ মৃতের সংখ্যা ৪১ : প্রশাসন

সাখাওয়াত কাওসার ও মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম থেকে

শোকে স্তব্ধ সীতাকুণ্ড বাতাসে পোড়া গন্ধ

আগুন লাগার দীর্ঘ সময় পর গতকালও বিএম কনটেইনার ডিপোতে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। স্বজনের খোঁজে অপেক্ষা আহাজারি -রোহেত রাজীব

বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি এলাকা। বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে পোড়া গন্ধ। এ ভয়াবহ ঘটনার পর দুই দিন কেটে গেলেও একরকম মানসিক আঘাতের মধ্যেই দিনাতিপাত করছেন বিএম কনটেইনার ডিপোর পাশর্^বর্তী এলাকার বাসিন্দারা। যে কোনো মুহূর্তে ফের বিস্ফোরণ হতে পারে এমন আতঙ্কও কাজ করছে তাদের মধ্যে।

ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকার অনেক বাসিন্দা নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় অন্যত্র আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। রাত হলেই শীতলপুরসহ আশপাশের এলাকায় নেমে আসছে রাজ্যের নীরবতা। গতকালও পরিবার পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনের।

সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল বলেন, ‘সোমবার সকালে ডিপোতে থাকা চারটি কনটেইনারে ভয়ংকর রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে। এগুলো ফায়ার সার্ভিসের দল বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে অপসারণ করার চেষ্টা করছে। তাছাড়া ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনো কালো ধোঁয়া থাকায় সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা সেখানকার আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করে যাচ্ছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

সরেজমিন দেখা যায়, বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন এবং বিস্ফোরণের পর দেড় দিন অতিবাহিত হলেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফায়ার সার্ভিস এবং সেনা সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কনটেইনারগুলো থেকে বের হচ্ছিল ধোঁয়া। এরই মধ্যে গতকাল সকালে ডিপোতে থাকা চারটি কনটেইনার থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস। যদিও সেই কনটেইনারগুলো নিরাপদে সরানো হয়েছে। মালিক পক্ষের কোনো লোক না থাকায় ডিপোতে আর কোনো ভয়ংকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি নির্বাপণ কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলো। তাই তাদের মধ্যেও বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক।

বিএম কনটেইনার ডিপোর পাশর্^বর্তী সুলতান সওদাগর বাড়ির সৈয়দ আহমেদ জানান, ‘বিস্ফোরণের পর ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। এরপর থেকেই পরিবারের সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। পরিবারের সব সদস্যকে কয়েক কিলোমিটার দূরের এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

কেশবপুর এলাকার নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পরই শ্বশুরবাড়িতে পরিবার পরিজনকে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় আতঙ্কের মধ্যে আছি। তাই তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তাদের ফিরিয়ে আনা হবে।’

নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাওয়া হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘শুনেছি এখনো ডিপোতে অনেক রাসায়নিক আছে। এ রাসায়নিকের কারণে আবার বিস্ফোরণের শঙ্কা রয়েছে। তাই আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছি।’

পর্যন্ত যাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে : সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে নিহত ২৬ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। তারা হলেন, মোমিনুল হক, মো. সুমন, হাবিবুর রহমান, মো রিদুয়ান, তৌহিদুল হাসান, মো হারুন, মো মনিরুজ্জামান, তাওহিদুল ইসলাম, তোফায়েল আহমদ তোফা, মো. সোহেল, মো. নয়ন, আফজাল হোসেন, শাহাদত উল্লাহ মজুমদার, মো. আলাউদ্দিন, শাকিল তরফদার, নাজিম উদ্দিন রুবেল, মো. মহিউদ্দিন, রানা মিয়া, রমজানুল ইসলাম, ইব্রাহিম হোসেন, শাহাদাত হোসেন, নিপন চাকমা, ফারুক জমাদ্দার, রবিউল আলম, মিঠু দেওয়ান এবং মো. সালাউদ্দিন।

পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ‘ঘটনার প্রথম দিন থেকেই লাশ শনাক্তের কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের আঙুলের চাপ, জব আইডি, ঘড়িসহ অন্যান্য আলামতের সাহায্য নিয়ে ২৬ লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি লাশগুলোর পরিচয় শনাক্তের কাজ করে যাচ্ছে পিবিআই।’

এদিকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা ৪৯ নয় ৪১ জন। দুই বার গণনায় এই ভুল হয়েছিল।

সরকারের উচ্চপদস্থদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন : সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। সোমবার তারা পৃথক পৃথকভাবে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘কনটেইনার ডিপোর আগুন এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় কারও অবহেলা বা দায় থাকলে ছাড় দেওয়া হবে না। সে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। প্রতিবেদন আসার আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। এ ঘটনার ফলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কাজেই আমরা এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স থাকব।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে আহতদের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওষুধ এবং খাবারের কোনো সংকট নেই। যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর