দেরিতে হলেও অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন অর্থনীতি একটি সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে। তবে তিনি এ সমস্যার সংকটের মূল উৎস দেখেন বাইরে, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিতে। দেশের ভিতরে কাঠামোগত সমস্যাগুলো উঠে আসেনি কথায়।
দেশের সংকটপূর্ণ সমস্যার মূল বিষয় যে মূল্যস্ফীতি, তা এখন সবাই একমত হচ্ছেন। এই মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে আগামী বছরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে কীভাবে নেমে আসবে, সে পথরেখা স্পষ্ট হয়নি। তবে মনে হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে একটি সীমিত সরকারি আয়-ব্যয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগোতে চাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে দেখা যাচ্ছে, দেশের জিডিপির অংশ হিসেবে আগামী বছরে সরকারি ব্যয় কমবে। এখন বর্তমানে যেটি ৭ দশমিক ৬ বলা হচ্ছে সেটি ৬ দশমিক ৭ এ আসবে। অর্থাৎ আগামী বছর সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ জিডিপির অংশ হিসেবে সাড়ে ৩১ শতাংশ, যা সমাপ্য বছরের চেয়ে কম। অর্থাৎ বিনিয়োগের যে উচ্ছ্বাসপূর্ণ বক্তব্য আগে শুনতাম তা এ বছর অনেক সংযত।
আর সরকারের ব্যয় আয়ের তুলনায় কিছুটা বাড়বে। কারণ, আয়কে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপির অংশ হিসেবে স্থির করা হয়েছে। অর্থাৎ আয় কিন্তু জিডিপির অংশ হিসেবে বাড়ছে না। বাড়বে ব্যয়। ব্যয় বৃদ্ধিটা উন্নয়ন ব্যয় নয়, পরিচালন ব্যয়। অর্থাৎ উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য সরকারের যে পরিমাণ খরচ করতে হয় তার পরিমাণ বাড়বে। এর ফলে বাজেট ঘাটতি বাড়বে।এর মূল কারণ হচ্ছে, আগামী বছর অবশ্যই সরকারকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। সমস্যা হচ্ছে ভালো ভর্তুকিও হয়, খারাপ ভর্তুকিও হয়। ভালো ভর্তুকি হচ্ছে- যখন প্রত্যক্ষভাবে সরকারি টাকা দিয়ে গরিব, দুস্থ মানুষকে আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়া হয়। আর খারাপ ভর্তুকি হচ্ছে- যখন বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থে বিভিন্ন কাজে অযৌক্তিকভাবে সরকারি ব্যয় করি। এ বছরের চেয়ে ঘাটতি বেশি সাড়ে ? শতাংশ, সেটার বড় অংশ পূরণ হবে বিদেশি বাজেট সহায়তা, বিশ্বব্যাংক, এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে সহায়তা নিয়ে। এ ছাড়াও সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে। বাজেট ঘাটতির প্রায় ৪৪ শতাংশ সরকার মেটাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। যেটি অবশ্যই ব্যক্তি বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলবে। যেসব আর্থিক পদক্ষেপ রয়েছে তার ভালো দিক হচ্ছে- যেসব অর্থনৈতিক কাজকর্ম অপ্রয়োজনীয় করের আওতার বাইরে ছিল সেসব খাতকে করের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সঠিকভাবে বিভিন্ন করহার সমন্বয় করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক কর রেয়াতও তুলে নেওয়া হচ্ছে। সেটাও ঠিক আছে। এ ছাড়াও বেশ কিছু উপকারী পদক্ষেপ রয়েছে যেমন প্রতিবন্ধীদের কাজ দিলে কর সুবিধা দেওয়া। কিন্তু যে দু-একটি বিষয় চোখে লাগবে, মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করবে সেটি হলো- করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ যে ৩ লাখ টাকা করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল, সেটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে বাড়ানো হলো না। এটা নিঃসন্দেহে অবিবেচক অবস্থান। তার চেয়ে বড় সমস্যা হবে, বিদেশে পাচারকৃত অর্থকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে দেশে আনার ঘোষণা। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় এগুলো বিদেশে অর্জিত সম্পদ। অথচ আমরা জানি, এগুলো অবৈধ উপায়ে দেশের ভিতরে অর্জিত সম্পদ। আবার অবৈধ উপায়ে বিদেশে গেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন পদক্ষেপ বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দেবে। এটি বর্তমান শাসক দলের সামাজিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ সে প্রশ্নও উঠবে। আরও উঠবে এ কারণে যে, বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের অবৈধ সম্পদ খোঁজখবর নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে সময়ে এমন একটি পদক্ষেপ বাংলাদেশে পাচারকৃত অর্থকে বৈধতা দেওয়া, বিশেষ করে যারা সৎ করদাতা তাদের এক-পঞ্চমাংশ করে সুবিধা করে দেওয়া, এটি কোনোভাবেই অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত নয়, রাজনৈতিকভাবেও হঠকারী বটে।
লেখক : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)