কলকাতার পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের পাশে কনস্টেবলের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত মোটরবাইক যাত্রীর বাড়িতে এখন শোকের ছায়া। চালক বশির আলম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা মুমূর্ষু। এ ঘটনায় চোদুপ লেপচা নামে ওই পুলিশ কনস্টেবলও আত্মঘাতী হন। এদিকে মৃত রিমার সঙ্গে আত্মঘাতী পুলিশ কনস্টেবলের সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিহত পুলিশ কর্মী স্পেশাল প্রোটেকশন ফোর্সে পোস্টিং ছিলেন। কয়েক দিন আগে কলকাতা পুলিশের পঞ্চম ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। শুক্রবার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের বাইরের আউটপোস্টে কর্মরত ছিলেন তিনি। সহকর্মীদের কাছে চা পান করার নাম করে বাইরে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন অ্যাপনির্ভর বাইকের চালক বশির আলম। তার বাইকের পেছনে থাকা রিমা সিংহ (২৮) গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। চালক বশিরের গুলি লাগে তার ডান কাঁধে। এক্স-রে করে দেখা গেছে তার ডান হাতের বাজুবন্ধনী বা স্ক্যাপুলা বোনের কাছে বুলেট বিদ্ধ হয়। প্রথমে তাকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলেও পরে এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। শরীর থেকে এখনো বুলেট বের করা সম্ভব হয়নি। খুব শিগগিরই করা হবে অস্ত্রোপচার। বশির আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, তাদের লক্ষ্য করে পরপর দুই রাউন্ড গুলি চালায় নিহত ওই কনস্টেবল। একটি গুলি লাগে রিমার শরীরে। চলন্ত বাইক থেকে তিনি পড়ে যান এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। অন্যটি লাগে বশিরের শরীরে। সেই অবস্থায় তিনি পার্ক সার্কাসের কর্মরত পুলিশের কাছে চলে যান। গতকাল ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে আসে। সিসিটিভি ফুটেজের সময় অনুযায়ী ওই দিন দুপুর ২.২৭ মিনিটে ওই ঘটনা ঘটে। ফুটেজে দেখা গেছে রিমা সেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছু সময় আগে ওই রাস্তায় আশপাশের কিছু মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছিল। সম্ভবত ততক্ষণে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে দিয়েছিলেন ওই পুলিশকর্মী। যে বাইকে চেপে রিমা যাচ্ছিলেন তার আগেই ওই রাস্তা দিয়ে আরও একটি স্কুটি চলে যেতে দেখা যায়। তারাই বারবার পেছনে ঘুরে দেখছিলেন। এরপর হঠাৎ করেই ২.২৭ মিনিটে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল রিমার বাইক। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় ছিটকে পড়েন রিমা।
নিমেষের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায় গোটা এলাকা। ঘটনার আকস্মিকতায় যে যার মতো লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। এর পর ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে রিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। যদিও কোন জায়গা থেকে রিমা সিংহ বশিরের বাইকে উঠেছিলেন তা এখনো জানা যায়নি। বশির ও রিমার উভয়েরই ফোনের কললিস্ট খতিয়ে দেখছে পুলিশ তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
রিমার সঙ্গে নিহত পুলিশ কনস্টেবলের কোনো সম্পর্ক ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ গোলাগুলির সময় ঘটনাস্থলে বহু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আশপাশ থেকে আরও কয়েকটি গাড়ি যাতায়াত করতে দেখা গেছে। তা সত্ত্বেও গুলি কেন শুধু বশির ও রিমার শরীরে লাগল, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। যদিও বশির সুস্থ হলে তাকে জেরা করেই এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে পারে তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে মোহাম্মদ সরফরাজ আলম নামে আহত ১৯ বছর বয়সী এক তরুণের হাতে গুলির বারুদের আঘাত রয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তার বয়ান রেকর্ড করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
এদিকে গতকাল সকাল থেকেই শোকের ছায়া নেমে আসে রিমার বাড়ি হাওড়ার দাসনগরে। ময়নাতদন্তের পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়েকে (ফিজিওথেরাপিস্ট) হারিয়ে দিশাহারা গোটা পরিবার। জানা গেছে, সম্প্রতি রিমার বিয়ের কথা শুরু হয়েছিল। শুক্রবার বিকালে ওই ঘটনার খবর পেয়ে রিমার বাড়িতে আসেন তার হবু বর। কার্যত তিনিও শোকে স্তব্ধ। গতকাল নিহত তরুণী রিমার মা মীরা সিংহকে ফোন করে সমবেদনা জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মীরা জানান, ‘মুখ্যমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে, আমি তো মেয়েকে ফেরত দিতে পারব না, আমি পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব, যতটা পারব করব। মুখ্যমন্ত্রী থেকে পরিবারকে ৫ লাখ রুপি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রিমার ভাইকে হোম গার্ডের চাকরি এবং তার বাবাকে একটি দোকান করে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
রিমার বাড়িতে যান সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়, কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। মন্ত্রীও ওই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।